বৃহস্পতিবার, ৬ অক্টোবর, ২০১৬

মানুষ কাকে বলে?

মানুষ কাকে বলে?

·         ‘মানুষ ও তার হৃদয়ের মাঝখানে আল্লাহ্ অবস্থান করেন’ (৮:২৪)।
·         ‘আমি তো মানুষকে সৃষ্টি করেছি শ্রেষ্ঠতম অবয়বে’ (৯৫:৪)।
·         ‘আমি তার গ্রীবাস্থিত ধমনীর চেয়েও নিকটতর’ (৫০:১৬)।
·         ‘তুমি আল্লাহ্ প্রকৃতি অনুসরণ করো, যে প্রকৃতি অনুযায়ী তিনি মানুষ সৃষ্টি করেছেন।  এ-ই সরল ধর্ম; কিন্তু অধিকাংশ মানুষ তা জানে না’ (৩০:৩০)।
·         ‘তিনিই মানুষকে পৃথিবীতে তাঁর প্রতিনিধি করেছেন’ (৩৫:৩৯)।
·         ‘তিনি পৃথিবীর সবকিছু মানুষের জন্য সৃষ্টি করেছেন’ (২:২৯)।
সংলাপ ॥ কুরআনের কেন্দ্রে রয়েছেন সর্বজ্ঞ আল্লাহ্ আর এর পরিধি হচ্ছে মানুষ। আজ জলে, স্থলে, অন্তরীক্ষে সর্বব্যাপী অনুরণিত হচ্ছে মানুষের জয়গান। মানুষ নিজেকে পৃথিবীতে সর্বশ্রেষ্ঠ জীব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে তার বিবেক-বুদ্ধি ও চিন্তাশক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে। মানুষ গঠন করেছে সমাজ, গঠন করেছে রাষ্ট্র আবার মানুষই সেই রাষ্ট্র ভাঙার সূত্র আবিষ্কার করেছে নিজেরই প্রয়োজনে। মানুষ গড়েছে নগর, মহানগর, গড়েছে সভ্যতা-সংস্কৃতির অভ্রংলিহ প্রাসাদ।
পাতঞ্জলি, সক্রেটিস, বুদ্ধ, বাল্মিকী, নূহ, দাউদ, মুসা, ঈসা, মোহাম্মদ (যার কৃপা আমাদের উপর বর্ষিত হোক)-এঁরা সবাই মানুষ। এঁরাই ধ্রুবতারা রূপে মানবজাতিকে পথপ্রদর্শন করছেন জ্যোতির্ময়ের জ্যোতির দিকে। অন্যদিকে আলেকজান্ডার দ্যা গ্রেট, চেঙ্গিস খাঁ, হালাকো খাঁ, মুসোলিনি, হিটলার, স্ট্যালিন এরাও মানুষ। মানুষই গড়ে, মানুষই ভাঙ্গে। মানুষ যেভাবে ভালো চায় সেভাবেই মন্দ চায় (১৭:১১)।  মানুষই আনে পরিবর্তন। নিজেই সৃষ্টি করে নিজের ভবিষ্যত। ‘মানুষ তাই পায় যা সে করে’ (৫৩:৩৯)। মানুষ নিজেকে ভেঙ্গে সৃষ্টি করে নতুন মানুষ। মানুষই যুদ্ধ করে, আবার মানুষই শোনায় শান্তির সুললিত বাণী। অবতার, নবী-রসুল, বিধাতা, স্বর্গ-নরক, আজাজিল-সবই আছে মানুষের রূপে। মানুষই ফেরেশতা, মানুষই ইবলিস আবার মানুষের মধ্যেই আল্লাহর প্রকাশ।
মানুষ আল্লাহ্ রহস্য, আর আল্লাহ্ মানুষের রহস্য। আল্লাহ্ সবচেয়ে প্রিয় সৃষ্টি হচ্ছে মানুষ। কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে মানুষের কাছে, মানুষেরই জন্য (৩৯:৪১)। জ্ঞানময় কুরআন মানুষকে সরলতম পথ প্র্রদর্শন করে। তিনি মানুষের জন্য বিভিন্ন উপমা দিয়ে তার বাণী বিশদভাবে বর্ণনা করেছেন। কুরআন মানবজাতির জন্য স্পষ্ট ব্যাখ্যা এবং সাবধানীদের জন্য পথপ্রদর্শক ও শিক্ষা (৩:১৩৮)।
এই কল্যাণময় কুরআন কিভাবে চিত্রিত করেছে মানুষকে? কুরআনের দৃষ্টিতে মানুষ কে? যার দু’টি হাত, দু’টি পা আছে, সোজা হয়ে হাঁটতে পারে, কথা বলতে পারে যে, সে-ই কি মানুষ? না-কি যার মনুষ্যত্ব আছে, বিবেক-বুদ্ধি আছে, বিশ্বাস-প্রেম-প্রীতি-ভালবাসা-সংযম আছে সে-ই মানুষ?  না-কি উল্লিখিত উভয় প্রকারের প্রাণীই মানুষ? তাহলে অমানুষ কাকে বলে? মানুষই বা কাকে বলে? নানা মানুষ নানাভাবে দিয়েছে এ প্রশ্নের উত্তর। কিন্তু শ্রেষ্ঠ উত্তরটি তাঁরই যিনি মানুষ সৃষ্টি করেছেন। পরম স্রষ্টা কাকে মানুষ বলেছেন, এটাই  প্রশ্ন।
আল্লাহ্ কিভাবে সৃষ্টি করলেন মানুষকে? তিনি মানুষকে সৃষ্টি করলেন ফেরেশতা এবং শয়তানের সমন্বয়ে। ফেরেশতাগণ হচ্ছেন চরম ভালো, এরা ভালো ব্যতীত মন্দ করতেই পারেন না। অন্যদিকে শয়তান হচ্ছে চরম মন্দ, তিনি মন্দ ব্যতীত অন্য কিছু করতেই পারেন না। সুতরাং ফেরেশতা এবং শয়তান সৃষ্টি করে আল্লাহ্ সৃষ্টির আনন্দই পেলেন না। তাই ফেরেশতা এবং শয়তান অর্থাৎ চরম ভাল এবং চরম মন্দের সমন্বয়ে আল্লাহ্ সৃষ্টি করলেন মানুষ। বৈপরীত্যের সমাহার ও দ্বন্দ্ব দিয়ে মানুষ সৃষ্টি করে পূর্ণতা পেলো লীলাময়ীর লীলা।  তিনি সৃষ্টি করলেন এমন এক প্রাণী যা ভালোও নয় মন্দও নয়। তবে তাকে দান করা হলো ভালো ও মন্দের জ্ঞান (৯১:৮-৯), স্বাধীনতা দেয়া হলো - যে কোন একটা বেছে নেবার। বলে দেয়া হলো, প্রত্যেকেই ভোগ করবে তার কর্মফল। আল্লাহ্ মানুষকে যোগ্যতা দিলেন আকাশ এবং পৃথিবীকে অতিক্রম করার, জগতকে জানবার, সত্য ও সুন্দরকে জানবার। সুতরাং মানুষ স্বর্গেরও নয় মর্ত্যরেও নয়, মরও নয় অমরও নয় কিন্তু মানুষের যোগ্যতা আছে অমর হবার। মানুষ ইচ্ছে করলে নিজেকে বিকশিত করে জীবাত্মা থেকে মানবাত্মা, মানবাত্মা থেকে মহাত্মা, মহাত্মা থেকে পরমাত্মায় আশ্রিত হতে পারে আবার ইচ্ছে করলে পশুর স্তরে কিংবা এর চেয়েও নিম্নস্তরে নেমে যেতে পারে।
এইভাবে মানুষ সৃষ্টি করে পরমানন্দে স্রষ্টা তাঁর ফেরেশতাদের আদেশ করলেন মানুষকে সিজদা করতে (২ঃ৩৪)। একজন ব্যতীত সকল ফেরেশতারাই তাকে সিজদা করলো। তিনি প্রমাণ করলেন - মানবের উত্তম কিছু নাই। সবার উপরে মানুষ। মানুষ আশরাফুল মাখলুকাত। শুধু ফেরেশতাদের থেকেই শ্রেষ্ঠ নয়, সকল সৃষ্টি থেকে শ্রেষ্ঠ। কিন্তু মানুষের এই শ্রেষ্ঠত্ব কোথায়? মানুষ শারিরীক গঠনে কিংবা পেশীশক্তিতে অন্যান্য জীবের থেকে শ্রেষ্ঠ নয়। মানুষ শ্রেষ্ঠত্ব জ্ঞানে। কারণ, আল্লাহ্ নিজে মানুষকে শিক্ষা দিয়েছেন এবং মানুষকে যে জ্ঞানের দিক থেকে ফেরেশতাদের থেকেও শ্রেষ্ঠত্ব দান করা হয়েছে তা তিনি ফেরেশতাদের ডেকে জ্ঞানের পরীক্ষা নিয়ে ফেরেশতাদের সামনে প্রমাণ করে দিয়েছেন (২ঃ৩১-৩৩)। রসুল (সা.) বলেছেন - যে জ্ঞান আহরণের জন্য পা বাড়ায় আল্লাহ্ তাকে বেহেশতের দিকে পথনির্দেশ করেন’। কুরআন বলছে - ‘যারা জানে এবং যারা জানে না তারা সমান হতে পারে না।’ কুরআন জ্ঞানকে আলো, অজ্ঞতাকে অন্ধকার, জ্ঞানবানকে জীবিত এবং অজ্ঞ ব্যক্তিকে মৃত বিবেচনা করেছে। আল্লাহ্ বলছেন - ‘অন্ধ এবং চক্ষুষ্মানরা এক নয়। অন্ধকারের গভীরতা এবং আলোর উজ্জলতা এক নয়।’ সুতরাং সিদ্ধান্ত আসে - যিনি যতটা জ্ঞানবান হতে পেরেছেন তিনি ততটা মানুষ হয়ে উঠেছেন। কে কতটা মানুষ তার নির্ণায়ক - জ্ঞান। কুরআনের দৃষ্টিতে মানুষের আকৃতি থাকলেও যাদের জ্ঞান নেই তারা অমানুষ বা মানুষ বলে গণ্য হবার অযোগ্য। যাদের অন্তর আছে, কিন্তু তা দিয়ে যারা উপলব্ধি করতে পারে না, যাদের চোখ আছে কিন্তু তা দিয়ে যারা দেখতে পারে না, যাদের কান আছে কিন্তু তা দিয়ে যারা শুনতে পারে না। তারা (আকৃতিতে মানুষ হলেও আসলে) গৃহপালিত পশুর ন্যায় (৭ঃ১৭৯)। আল্লাহর নিকট নিকৃষ্টতম জানোয়ার হলো তারাই (যদিও এদের আকৃতি মানুষেরই মতো) যারা বধির ও বোকা এবং যারা কোন কিছুই বুঝতে পারে না (৮ঃ১২)। কুরআনের সিদ্ধান্ত হলো - মানুষের আকৃতি বিশিষ্ট প্রাণীই মানুষ নয়। যারা শুনতে ও বুঝতে পারে না, যাদের জ্ঞান নেই যারা সত্য ও খাঁটি পথ থেকে দূরে বিচরণ করে তারা গৃহপালিত জানোয়ার (২৫ঃ৪৪)।
অন্যদিকে, মানুষ আল্লাহর প্রতিনিধি (২ঃ৩০)। ‘তিনিই মানুষকে পৃথিবীতে তাঁর প্রতিনিধি করেছেন’ (৩৫ঃ৩৯) এবং ‘পৃথিবীর সবকিছু মানুষের জন্য সৃষ্টি করেছেন’ (২ঃ২৯)। তিনি মানুষের অধীন করে দিয়েছেন আকাশ মন্ডলী ও পৃথিবীর সবকিছু (৪৫ঃ১৩)। মহাবিশ্বে যা কিছু আছে সবকিছু ভোগ করার অধিকার মানুষের আছে। কিন্তু আল্লাহ্র প্রতিনিধি হিসেবে আকাশ-জমিন-পানিতে যা কিছু আছে সবকিছুর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বও মানুষের। সমগ্র মহাবিশ্বের দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়ে মানুষ মর্যাদাবান হয়েছে। আল্লাহ্ সৃষ্টির প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনের পরই প্রতিষ্ঠিত হয় ভোগের অধিকার। আল্লাহ্ হচ্ছেন রব বা পালনকর্তা। পালনকর্তার প্রতিনিধি হিসেবে মানুষের দায়িত্ব হচ্ছে সমগ্র সৃষ্টিকে পালন করার ক্ষেত্রে প্রত্যেকের সামর্থ্য অনুযায়ী ভূমিকা রাখা। সুতরাং নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকলেই আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে মানুষ নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবে না। আকাশে ও পৃথিবীতে যা-কিছু আছে সবই আল্লাহ্ (২ঃ২৮৪)। তাই, জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে যা কিছু আছে পশু-পাখি, কীট-পতঙ্গ, জীব-জন্তু, গাছ-পালা ইত্যাদি সবকিছুর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব মানুষের।
মানুষ শুধু আল্লাহর প্রতিনিধি নয়। মানুষ আল্লাহ্ আব্দ বা দাস। মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে শুধুমাত্র তাঁর ইবাদত করার জন্য (৫১ঃ৫৬)। যেহেতু আল্লাহ্ তায়ালা শুধুমাত্র তাঁর ইবাদত করার জন্যই মানুষকে সৃষ্টি করেছেন, সেহেতু ইবাদত ব্যতীত আর কিছু করলে তা মানব সৃষ্টির উদ্দেশ্যের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হবে না। ইবাদতের দু’টি অংশ - একটি হচ্ছে আল্লাহর প্রতি কর্তব্য পালন করা (হক্কুল্লাহ্) অন্যটি হচ্ছে প্রতিনিধি হিসেবে সৃষ্টির প্রতি দায়িত্ব পালন করা (হক্কুল এবাদ)। মানুষকে দু’টি চোখ দেয়া হয়েছে - যেন একটি চোখ থাকে আল্লাহর দিকে আর অপরটি সৃষ্টির দিকে; মানুষকে দু’টি হাত দেয়া হয়েছে যেন একটি হাত আল্লাহ্ দিকে আর অন্য হাতটি মানুষের দিকে প্রসারিত হয়, মানুষের দু’টি কান দেয়া হয়েছে - যেন একটি দিয়ে সে আল্লাহ্ নির্দেশনা এবং অন্যটি দিয়ে সৃষ্টির আহ্বান শুনতে পায়।
আল্লাহর সমগ্র বিধানকে চার ভাগে ভাগ করলে দেখা যায় এর তিন চতুর্থাংশ ব্যাপী রয়েছে সৃষ্টির প্রতি কর্তব্য বা হক্কুল এবাদের আলোচনা। দুনিয়ার কাজ-কর্ম পরিত্যাগ করে গাছতলায় বসে ‘আল্লাহু’ ‘আল্লাহু’ যিকির করাই কেবল ইবাদত নয়। কারণ আল্লাহ্ পূর্ণ, অভাবমুক্ত, সর্বজ্ঞ এবং সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী, তিনি কারো যিকিরের মুখাপেক্ষী নন। তাই আল্লাহ্ তায়ালা চান না যে মানুষ কেবল তাঁরই নাম জপ করুক, আল্লাহ্ যদি মানুষের কাছ থেকে কেবল যিকির এবং তসবীহ-তাকসীদ অর্থাৎ, ‘আল্লাহ্ হক’-ই চাইতেন তবে তিনি আর ‘মানুষ’ সৃষ্টি করতেন না। ফেরেশ্তারাইতো দিবা-নিশি তাঁর নাম জপ করছিলেন। আল্লাহ্ তায়ালা ইচ্ছা করলে আরো অসংখ্য ফেরেশ্তা সৃষ্টি করতে পারতেন কিংবা মানুষকে এমনভাবে সৃষ্টি করতে পারতেন যে মানুষ তাঁর প্রশংসা ব্যতীত আর কিছুই করতো না। তবে কেন আল্লাহ্ তায়ালা মানুষকে এভাবে সৃষ্টি করলেন? কেন মানুষকে সৃষ্টি করা হলো বৈপরীত্যের সমাহার ও দ্বন্দ্ব দিয়ে - যার মধ্যে একদিকে প্রক্ষিপ্ত হয়েছে ক্ষুধা, তৃষ্ণা, যৌনাবেগ, ঘৃণা আর অন্যদিকে প্রেম, দয়া, আনন্দ ও বেদনার অনুভূতি? কেন মানুষকে এমনভাবে সৃষ্টি করা হলো যে, জীবন-যাপনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তাকে পরস্পরের মুখাপেক্ষী হতে হবে? মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে মানুষেরই জন্যে। তার মধ্যে সৃষ্টি করা হয়েছে এমন অভাববোধ যে, মানুষকে - মানুষেরই মুখাপেক্ষী হতে হবে। মানুষকে বেঁচে থাকতে হবে পরস্পরের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে। এ পারস্পরিক সম্পর্ক যদি আল্লাহ্ তায়ালার বিধান মতো হয় তবে তা-ই ইবাদত। আল্লাহ্ তায়ালার বিধান - মানুষকে ভালবাসার বিধান। মানুষকে ভালবাসাই আল্লাহকে ভালবাসা, মানুষের সেবা করাই আল্লাহ্ সেবা করা। রসুল (যার কৃপা আমাদের উপর বর্ষিত হোক) বলেন, ‘তুমি কি আল্লাহকে ভালবাসতে চাও? তাহলে এখন মানুষকে ভালবাসতে শেখ।’ মানুষকে ভাল না বেসে আল্লাহকে ভালবাসার চেষ্টা করা বৃথা। সৃষ্টিকে অবজ্ঞা করে স্রষ্টাকে ভালবাসার দাবি করা যায় না।
আসলে, আমাদের কোন কাজ-কর্মের পরোয়া করার প্রয়োজন আল্লাহ্ তায়ালার নেই। মানুষের কর্মফল মানুষই ভোগ করবে। আল্লাহ্ তায়ালা মানুষের মুখাপেক্ষী নন, মানুষই মানুষের মুখাপেক্ষী, আল্লাহ্ তায়ালার মুখাপেক্ষী। তাই যখন বলা হলো, ‘আমি মানুষকে আমার ইবাদত ছাড়া অন্য কোন কাজের জন্য সৃষ্টি করিনি’ - তখন মানুষের নিজেদের কল্যাণের জন্যই তা বলা হলো, আল্লাহ্ তায়ালার কল্যাণের জন্য নয়। একজন ভাল ডাক্তার তার রোগীর জন্য একটা ঔষধের কথা বলে দিলেন। এতে ডাক্তারের কোন লাভ নেই। ঔষধ সেবনে রোগীরই কল্যাণ - ডাক্তারের নয়। ইবাদতে কল্যাণ মানুষের। আর প্রকৃত ইবাদত হচ্ছে - গরিব, অসহায় মানুষের প্রতি সাহায্যের হাত প্রসারিত করা, নিরাশ্রয়কে আশ্রয় দেয়া, মজলুমকে জালেমের হাত থেকে রক্ষা করা, ক্ষুধার্তকে অন্ন দান করা, বস্ত্রহীনকে বস্ত্র দান করা, আর্ত-পীড়িতের সেবা করা। আল্লাহ্ তায়ালা মুসা (আ.) কে জিজ্ঞাসা করলেন,  ‘হে মূসা, তুমি আমার জন্য কি কি কাজ করেছ?’ মূসা বললেন, ‘আমি আপনার জন্য নামাজ পড়েছি, রোজা পালন করেছি এবং আপনাকে সিজদা করেছি’। আল্লাহ্ বললেন, ‘নামাজ পড়েছো দোজখের আগুন থেকে বাঁচবার জন্য, রোজা রেখেছো বেহেশ্তে যাবার জন্য, আর সিজদা করেছো বেহেশ্তে গিয়ে উচ্চ মর্যাদা পাবার জন্য, এগুলো তো তোমার নিজের জন্য করেছো, এগুলো তো তোমার কাজ। আমার জন্য কি করেছো তাই বলো’। মূসা (আ.) বললেন, ‘এগুলো যদি আপনার কাজ না হয় তবে বলে দিন আপনার কাজ কি কি।’ আল্লাহ্ বললেন - ‘কোন ক্ষুধার্ত ব্যক্তিকে কি পেট পুরে আহার করিয়েছ? কোন পিপাসাতুর ব্যক্তিকে কি পানি পান করিয়েছ? কোন মজলুম ব্যক্তিকে কি জালেমের হাত থেকে রক্ষা করেছ? কোন জ্ঞানী ব্যক্তিকে কি সম্মান করেছ? এইগুলো আমার কাজ’। এ কাজগুলো যারা করে তাদের মধ্যেই জাগ্রত হয় মনুষ্যত্ব। আল্লাহর দৃষ্টিতে তারাই মানুষ।
পরম করুণাময় আল্লাহ্ সৃষ্টির ঊর্ধ্বে কোন একটা বিশেষ স্থানে অবস্থিত ব্যক্তিক সত্তা নন। ‘মানুষ ও তার হৃদয়ের মাঝখানে আল্লাহ্ অবস্থান করেন’ (৮:২৪)। তিনি আছেন মানুষেরই মাঝে। ‘তিনজনের মধ্যে এমন কোনো গোপন পরামর্শ হয় না যাদের মধ্যে চতুর্থজন হিসাবে তিনি হাজির না থাকেন, পাঁচজনের মধ্যেও হয় না, যেখানে তিনি ষষ্ঠজন হিসেবে না থাকেন। সংখ্যায় ওরা এর চেয়ে কম বা বেশি হোক, ওরা যেখানেই থাক না কেন আল্লাহ্ ওদের সঙ্গে আছেন’ (৫৮:৭)। যেখানেই মানুষ আছে সেখানেই আল্লাহ্ আছেন। মানুষের মধ্যেই  আল্লাহ্ আছেন। মানুষের মৌল প্রকৃতিতে আল্লাহ্ অবস্থান। তিনি আছেন মানুষের গ্রীবাস্থিত ধমনীর চেয়ে নিকটতরে (৫০:১৬)। নীলাচল, কাশী, মথুরা বৃন্দাবন, বুদ্ধ গয়া, জেরুজালেম, মদিনা, কাবাঘর, মসজিদ, মন্দির, গির্জা, মুসা, ঈসা, মোহাম্মদ সবকিছুর বাসস্থান মানুষের দিল কাবা। এই দিল কাবার সন্ধান যে লাভ করেছে   সে-ই না মানুষ!
আল্লাহর কোন রূপ নেই।  মানুষ রূপেই তিনি নিজেকে করেছেন প্রকাশিত। মানুষ আকৃতিতে নয় প্রকৃতিতে স্বয়ং আল্লাহ্। আল্লাহ্ মানুষকে সুঠাম দেহের অধিকারী করেছেন এবং তাতে রুহ ফুঁকে দিয়েছেন (৩২ঃ৭)। আল্লাহ্ তাঁর প্রকৃতিতে মানুষ সৃষ্টি করেছেন (৩০ঃ৩০)। তাই খুঁজিতে হয় মানুষ, পূঁজিতে হয় মানুষ, ভজিতে হয় মানুষ। মানুষের মানসভূমি, মানুষের আরাধনায় উর্বর হলে আমিত্বের আবরণ ভেদ করে নিজেকে উন্মোচিত করেন তিনি। তাই লালন সাঁইজী বলেন, - ‘মানুষ থুইয়া খোদা ভজ, এ মন্ত্রণা কে দিয়াছে/ মানুষ ভজ, কুরআন খোঁজ পাতায় পাতায় সাক্ষী আছে’।
মানুষ না ধরে, আকাশের আল্লাহকে জানবার কোন উপায় নেই। কুরআন খুঁজলেই পাতায় পাতায় সাক্ষী পাওয়া যায়। মানুষের মধ্যে যিনি নিজেকে হারিয়ে ফেলেন তিনিই আল্লাহতে আশ্রিত হন। আল্লাহতে বিলীন হতে হলে তা মানুষের মাধ্যমেই হতে হবে। এটাই বিধির বিধান।
মানুষই সত্য। এ সত্যকে উপলব্ধি করেই মহামানুষ মনসুর হাল্লাজ ঘোষণা করেছিলেন - আনাল হক অর্থাৎ ‘আমিই আল্লাহ্’। শামসে তাব্রিজ ঘোষণা করেছিলেন - ‘আমিই আদি, আমিই অন্ত, আমিই গোপন, আমিই প্রকাশ্য। একবার তাঁকে প্রশ্ন করা হয়েছিলো, আপনি কি মুসলিম? শামসে তাব্রিজ উত্তর দিয়েছিলেন - ‘আমি অগ্নি উপাসকও নই, খ্রিস্টানও নই, ইহুদিও নই এবং মুসলিমও নই। আমি জীবনের মধ্যে নেই, মৃত্যুর মধ্যে নেই, আমি পানিতেও নেই, মাটিতেও নেই, আমি আগুনেও নেই, বাতাসেও নেই।’ একথা শুনে তাঁকে আবার প্রশ্ন করা হলো, ‘তাহলে আপনি কে’? উত্তরে তিনি বলেছিলেন - ‘আমি-ই সত্য’। শেখ ফরিদ বলেছিলেন - ‘আমিই ওলি, আমিই আলী, আমিই নবী, আমিই মাওলা, আমিই মহাবীর, আমিই মন্দিরের ব্রাহ্মণ পুরোহিত’। আল্লাহ্ তো মানুষেরই অন্তস্থিত শূণ্যতা। যে জেনেছে তা, সে পেয়েছে পূর্ণতা।
অমানুষও মানুষ। অমানুষ থেকে ‘অ’ বাদ দিলেই মানুষ হয় কিংবা মানুষের আগে ‘অ’ যুক্ত হলেই মানুষ অমানুষ হয়। কুরআন যেমন মানুষকে প্রশংসা এবং মর্যাদাবান করেছে তেমনি করেছে তিরষ্কার। কুরআন - অজ্ঞ, অথর্ব, অসৎ, অবিশ্বাসী, অকৃতজ্ঞ, অপব্যয়ী, অসন্তুষ্ট ইত্যাদি ‘অ’ যুক্ত মানুষকে অমানুষ বা গৃহপালিত পশু বা তার চেয়ে অধম হিসেবে তিরষ্কার করে। অমানুষকে মানুষ হতে হলে তাকে মানুষপন্থী হতে হয়। একজন চিত্রশিল্পী যেমন তার সামনে বাস্তব আদর্শ (মডেল) না থাকলে ছবি আঁকতে পারেন না ঠিক তেমনি অমানুষের সামনে কোন একজন মানুষ না থাকলে তিনি নিজেকে মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে পারেন না। ‘মানুষ’ -এঁর সংস্পর্শে না আসা পর্যন্ত অমানুষের উপলব্ধিই হবে না যে তিনি অমানুষ! কে কতটা মানুষ কিংবা অমানুষ তা বিচারের জন্য মানুষের সামনে এমন ‘এক’ নৈতিক এবং নান্দনিক আদর্শ থাকতে হবে যাঁর সঙ্গে তুলনা করে নিজেকে মানুষ কিংবা অমানুষ হিসেবে চিহ্নিত করতে পারে। ‘যে কর্ম আদর্শ অনুযায়ী সম্পাদিত হচ্ছে তা ভালো আর যে কর্ম আদর্শের পরিপন্থী তা মন্দ’ - এই নীতিতে অটল থেকে ‘আদর্শ’-কে সামনে রেখে, আদর্শ সাপেক্ষে,  কর্ম ও আচরণের নিয়ন্ত্রণ করতে থাকলে অমানুষ অবশ্যই মানুষ হবে। অমানুষ যতক্ষণ পর্যন্ত মানুষপন্থী না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত মানুষ হতে পারে না।
দুঃখজনক হলেও সত্যি, জগতে এখন মানুষপন্থী মানুষ খুবই কম। জগতে চীন-মস্কো-সৌদিপন্থী মানুষ আছে, বাম-ডান-মধ্যপন্থী মানুষ আছে, কুরআন-বেদ-বাইবেল-ত্রিপিটকপন্থী মানুষও আছে কিন্তু মানুষপন্থী মানুষের বড়ই অভাব। অথচ এটা সুবিদিত যে, মানুষপন্থী মানুষই আল্লাহ্পন্থী মানুষ।

প্রাণীকুলের সকলেরই একটা প্রকৃতিগত ধর্ম আছে। মানুষ ব্যতীত অন্য সকল প্রাণী তার প্রকৃতিতে কোন প্রকার বিকৃতি ছাড়াই সদা প্রতিষ্ঠিত কিন্তু তারা তা জানে না। তাই ধর্মে প্রতিষ্ঠিত হবার কোন তাগিদই তাদের নেই। ভূমিষ্ঠ হবার পর থেকেই মানব শিশুকে তার প্রাকৃতিক ধর্ম থেকে বিচ্যুত করার নিরবিচ্ছিন্ন প্রক্রিয়া চলতে থাকে। মানব শিশু বাড়তে থাকে এমন একটা পরিবেশে যে পরিবেশে সকলেই তাদের প্রকৃতিগত ধর্ম থেকে বিচ্যুত হয়েছে। জীবন বিকাশের একটি স্তরে উপনীত হয়ে যখন সে উপলব্ধি করতে পারে যে, সে নিজের প্রকৃতিগত ধর্মকে হারিয়ে ফেলেছে তখনই সে খুঁজতে থাকে তার ধর্ম। একমাত্র মানুষকেই সেই যোগ্যতা দিয়ে সৃষ্টি করা হয়েছে যে, যোগ্যতায় সে তাঁর প্রভুর নৈকট্য লাভ করতে পারে। কিন্তু এজন্য মানুষকে কঠোর কর্মসাধনা করতে হবে। যে এ লক্ষ্যে কঠোর সাধনা করে সে অবশ্যই তাঁর সাক্ষাত পাবে (৮৪:৬)। কঠোর সাধনার মাধ্যমে যে নিজেকে চিনবে সেই চিনবে তাঁর আল্লাহ্কে। কারণ মানুষ আল্লাহ্র সুরত। মানুষ যখন নিজেকে জানবে, নিজ ধর্মকে জানবে তখনই সে মানুষ, রূপান্তরিত হবে স্বয়ং সত্যে।  এ সত্যই মানবজীবনের পূর্ণতা। চলো - মানুষ হই, সত্যের অভিসারে হই সাহসী অভিযাত্রী। 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন