বৃহস্পতিবার, ২৭ অক্টোবর, ২০১৬

প্রত্যাশা উন্নত রাজনৈতিক সংস্কৃতি

প্রত্যাশা উন্নত রাজনৈতিক সংস্কৃতি

শেখ উল্লাস ॥ সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ধর্মগ্রন্থ শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার সারাংশ হিসেবে প্রচলিত আছে, ‘যা হয়েছে তা ভালই হয়েছে, যা হচ্ছে তা ভালই হচ্ছে, যা হবে তাও ভালই হবে।  ..তোমার কি হারিয়েছে, যে তুমি কাঁদছ? তুমি কি নিয়ে এসেছিলে, যা তুমি হারিয়েছ? তুমি কি সৃষ্টি করেছ, যা নষ্ট হয়ে গেছে? তুমি যা নিয়েছ, এখান থেকেই নিয়েছ। যা দিয়েছ, এখানেই দিয়েছ। তোমার আজ যা আছে কাল তা অন্য কারো ছিল। পরশু সেটা অন্য কারো হয়ে যাবে। পরিবর্তনই সংসারের নিয়ম’।
বাংলাদেশের সাম্প্রতিককালের রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের ওপর সাধারণ মানুষের আন্তরিক ভক্তি-শ্রদ্ধা-ভালোবাসা-আস্থা-বিশ্বাস কী বা কতটুকু আছে তা সচেতন মহলের কারো কাছেই ব্যাখার প্রয়োজন পড়ে না। এক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের মতো একটি বৃহৎ রাজনৈতিক দলের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম তার কথা, উদার দৃষ্টিভঙ্গি, সাহসিকতা, ব্যবহার, চিন্তা-চেতনা, বিশেষ করে দল ও দলের প্রধানের প্রতি আনুগত্য প্রকাশের মধ্য দিয়ে সাধারণ সচেতন মানুষদের, এমনকি তার দলের বিরোধী মহলের একটি বড় অংশের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তাই রাজধানীর ঐতিহাসিক সোহারাওয়ার্দী উদ্যানে স্মরণাতীতকালের সবচেয়ে বড় জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজনের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠিত জাতীয় সম্মেলনের সমাপনী দিনে দলের সাধারণ সম্পাদক থেকে সৈয়দ আশরাফের বিদায় সচেতন অনেককেই নাড়া দিয়ে গেছে-এটাই হয়তো স্বাভাবিক। এই পরিবর্তনই হয়তো এই জগৎ-সংসারের নিয়ম।
পলিটিক্যাল কালচার তথা রাজনৈতিক সংস্কৃতি বলতে যে কথাটি শিক্ষিত সমাজে প্রচলিত আছে তারও এক নতুন উদাহরণ সৃষ্টি হলো এবারের আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলনে। দলের সভাপতির পদে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা আবারো নির্বাচিত হবেন-এ নিয়ে কাউন্সিলরসহ সকলের মাঝেই ঐক্যমত্য ছিল।
কিন্ত সাধারণ সম্পাদক পদের দায়িত্ব কে পাচ্ছেন এ নিয়ে যখন দেশের রাজনীতিসংশ্লিষ্ট সকল মানুষ, গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমগুলোতে তোলপাড় হচ্ছিল, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের পার্শ্ববর্তী ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনকে ঘিরে, সবাই তাকিয়ে ছিল গণমাধ্যমের পর্দার দিকে, ঠিক তখনই জানা গেল সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম নিজেই প্রস্তাব করেছেন ওবায়দুল কাদেরের নাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই তা অনুমোদন হয়ে গেল সর্বসম্মতভাবে। অনেককেই অবাক করে দিয়ে সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম যে কাজটি করলেন তা তিনি কেন করলেন, এর জন্য তার ওপর কোনো চাপ ছিল কি-না সেটা জানা গেল না। যে-কারণেই হোক সৈয়দ আশরাফ যা করলেন তা দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে উদারতার এক নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতি তৈরি করলেন। প্রধানমন্ত্রী তাকে ‘আমার ছোট ভাই ও শহীদের সন্তান’ হিসেবে সম্বোধন করে রাজনীতির অঙ্গনে তাদের চলার পথে এক নতুন অধ্যায়ের অবতারণা করলেন। সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নেতৃত্ব বেছে নিতে অনেক জটিল অংকের সহজ সমাধান দিয়ে রাজনীতিতে সংস্কৃতির যে নতুন ধারা তিনি সৃষ্টি করলেন তা তার দল ও দেশের জন্য কল্যাণ কতটুকু বয়ে আনতে পারে সেটাই এখন দেখার বিষয়। সাধারণ সম্পাদক পদে ওবায়দুল কাদেরের আগমন নতুন হলেও দেশের এবং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের রাজনীতির সর্ব অঙ্গনে তার মতো বিচরণকারী খুব কমই আছে- একথা অনস্বীকার্য। ১৯৭৫’এর ১৫ই আগষ্ট-পরবর্তী বাংলাদেশ ছাত্রলীগ (কাদের-চুন্নু) পরিষদের সভাপতি হিসেবে ওবায়দুল কাদের নামটি রাজনীতিসংশ্লিষ্ট সাধারণ মানুষের কাছে বিশেষ পরিচিতি পেয়েছিল, সাংবাদিকতার সাথে, লেখালেখির সাথে যুক্ত ছিলেন দৈনিক বাংলার বাণীতে, এক এগারোর সময় জেল খেটেছেন দীর্ঘ দিন। সবচেয়ে বড় কথা, বর্তমান সরকারের আমলে প্রথমে যোগাযোগ মন্ত্রী এবং পরবর্তীতে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী হিসেবে তার কর্মকাণ্ড সর্বমহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। এ লেখায় আগেই বলা হয়েছে, আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগে এমন কি জাতীয় রাজনীতির অঙ্গনে বিচরণকারী তার মতো নেতা এদেশে কমই আছে। তবে এ নিয়ে বিভিন্ন কথাও আছে। রাজনৈতিক দল হিসেবে বর্তমানে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গ-সংগঠন ছাত্রলীগের মধ্যে, এমনকি সরকার ও প্রশাসনের মধ্যেও নবাগত বা রবাহুত অনেক নেতা-কর্মী এবং জামাত-বিএনপির এজেন্টরা যেভাবে ঢুকে পড়েছে-সে পরিস্থিতি মোকাবেলা করে তিনি দলকে কতটুক এবং কীভাবে এগিয়ে নিয়ে যাবেন-সেটা নিঃসন্দেহে এক চ্যালেঞ্জের বিষয়। দল ও সরকারের ভেতরকার দুর্নীতিবাজ, হাইব্রিড নেতাকর্র্মী, সুবিধাভোগী, টেন্ডারবাজ এক কথায় লুটেরাদেরকে সামলাতে না পারলে আগামীতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির জগতে সমূহ অবনতি ঘটবে বলে আশংকা তৈরি হয়েছে।
আওয়ামী লীগ সরকারের ভেতরে, দলের ভেতরে বিরোধী রাজনৈতিক শক্তির অনুপ্রবেশ, তাদের তৎপরতা ও কর্মকান্ড প্রকাশিত হবে (আল্লাহ্ না করুক) কোনোদিন তারা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর। এখনো দেশের সর্বত্র যে হারে দারিদ্র্য, ধর্মান্ধতা, দুর্নীতি ও মিথ্যাচার রয়েছে, তার দায়-দায়িত্ব মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল হিসেবে আওয়ামী লীগকেই বহন করতে হবে। আওয়ামী লীগ দেশ ও জাতির জন্য অনেক কিছু করেছে যেমন সত্য, আরও অনেক কিছু করতে পারেনি-এ অভিযোগও তেমনভাবে সত্য। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমার জীবনের একমাত্র কামনা, বাংলাদেশের মানুষ যেন তাদের অন্ন পায়, বস্ত্র পায় এবং উন্নত জীবনের অধিকারী হয়।’ বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার কতভাগ মানুষ বর্তমানে উন্নত জীবনের অধিকারী হয়েছে তা হিসেব করলে নিশ্চয়ই খুশি হওয়ার মতো কোন চিত্র উঠে আসবে না। বিপুল সংখ্যক মানুষ এখনো দারিদ্র্যসীমার নীচে অসহায়ের মতো জীবন-যাপন করে। তবে দারিদ্র্যের সাথে যুদ্ধ করে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে সেটা এখন বিশ্বব্যাংকও স্বীকার করে। এর জন্য বর্তমান সরকারের কৃতিত্ব বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বের লোকজনই এখন স্বীকার করছে। তবু যে আরো অনেক পথ পাড়ি দেওয়া বাকী। যে পথে পা পিছলে গেলে দেশকে আবারো অনেক নীচে চলে যেতে হবে। স্বাধীনতাবিরোধী দেশি-বিদেশি শক্তির একটাই তো চেষ্টা-দেশ যেন উঠে দাঁড়াতে না পারে এবং সে চেষ্টা তারা বিভিন্নভাবে করে যাচ্ছে। সরকার ও প্রশাসন এমনকি পুলিশ প্রশাসনের ভেতরে থেকে জামাত-বিএনপির লোকেরা কীভাবে সরকারের ভাবমূতি বিনষ্ট করছে, শান্তিপ্রিয় মানুষদের ওপর হামলা করছে তার জন্য উদাহরণ হওয়ার মতো একটি ঘটনা সম্প্রতি ঘটেছে যশোরের অভয়নগর উপজেলায়। সেখানকার ভবদহ এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে বিস্তীর্ণ জনপদে জলাবদ্ধতার কবলে পড়ে সাধারণ মানুষ সীমাহীন কষ্ট ও দুর্ভোগে রয়েছে যার সমাধানে সরকারের পক্ষ থেকে আজ পর্যন্ত কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। সম্প্রতি সেখানে পানিবন্দী মানুষদের সমস্যা সমাধানের দাবিতে ভবদহ পানি নিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটির শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে হামলা চালায় অভয়নগর থানার ওসি। এই হামলায় রক্তাক্ত হন ওয়ার্কাস পার্টির পলিটব্যুরোর সদস্য ইকরাব কবির জাহিদসহ ৫০ জন সাধারণ মানুষ। দৈনিক সংবাদ গত ১৯ অক্টোবর এক অনুসন্ধানমূলক সংবাদ প্রতিবেদনে লিখেছে, ওসি আনিসুর রহমানের (ডাক নাম লিটন) বাড়ি নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলার ধোপাদহ গ্রামে। তার দাদার দুই ভাই মোফাজ্জেল মোল্লা ও আবুল হোসেন মোল্লা মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজাকার বাহিনীতে যোগ দেন এবং এলাকার সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোক জনের বাড়িঘর লুটপাট করে ও পুড়িয়ে দেয়। মুক্তিকামী মানুষ এক পর্যায়ে মোফাজ্জল মোল্লাকে হত্যা করে, আর আবুল হোসেন পালিয়ে বাঁচেন। বিএনপি গঠিত হবার পর লিটনের জ্ঞাতি গোষ্ঠী জামায়াতের খোলস পাল্টিয়ে বিএনপিতে যোগ দেয়। লিটন যুক্ত হয় ছাত্রদলের সঙ্গে। তার বড়ভাই মিজানুর রহমান স্বপন ও চাচা আজিজুর রহমান ফুল লোহাগড়া বিএনপির চালিকা শক্তি। এই সুবাদে রাজাকার আবুল হোসেন মোল্লার ছেলে অর্থাৎ, লিটনের চাচা সাইফুর রহমান ও লিটন ১৯৯০-এর দশকে বিএনপি আমলে এক সঙ্গে পুলিশের সাব-ইনস্পেক্টর পদে চাকরি পান। লিটনের আর এক চাচা বিএনপি নেতা হিসেবে খুলনায় খালেদা জিয়ার জনসভায় অংশ নিতে গিয়ে বাস দুর্ঘটনায় নিহত হন। জামায়াত-বিএনপি দলের আনিসুর রহমান লিটন আওয়ামী লীগ ও মহাজোটের নেতৃত্বাধীন জোটের বিরুদ্ধে প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে চান’। এই প্রতিহিংসারই বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন পানিবন্দী মানুষদের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে হামলার মধ্য দিয়ে। এই ছোট্ট ঘটনাটির মধ্য দিয়ে তারা তাদের আজকের দিনের রাজনৈতিক সংস্কৃতির একটি রূপ দেখিয়েছেন। আওয়ামী লীগ সরকার, প্রশাসন এবং তাদের দলের ভেতরে সর্বস্তরে এ ধরনের জামায়াত-বিএনপিপন্থী অনেক কর্মকর্তা-নেতা-কর্মী বিভিন্ন অপকৌশলে শান্তিপূর্ণ মানুষদের ওপর হামলা চালিয়ে সরকারের ভাবমূর্তি নানাভাবে বিনষ্ট করছে।
এদেরই আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছে সরকার ও দলের মধ্যে ঘাপটি মেরে থাকা অনেক অপশক্তি। জনগণের পাশে থেকে, জনগণের স্বার্থ উদ্ধারে আন্দোলন-কর্মসূচি গ্রহণ না করে তাদের দুর্দশা-দুর্ভোগ বৃদ্ধিতে সহযোগিতা করছে এমন রাজনৈতিক শক্তি দেখতে চায় না এদেশের বিবেকবান মানুষ। বরং এই জাতীয় অপশক্তি ও অপসংস্কৃতিকে প্রতিরোধ করে দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি (পলিটিক্যাল কালচার)কে উন্নত ও যুগোপযোগী করতে পারলেই কেবল সমাজ ও জাতি সমৃদ্ধ হবে-মানুষ উন্নত জীবনের অধিকারী হওয়ার পথে এগিয়ে যাবে। বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনা, সাড়া জাগানো ও জাঁকজমকপূর্ণ জাতীয় সম্মেলনের আয়োজন স্বার্থক হয়ে উঠবে-এটাই আজকের জাতির বিবেকের প্রত্যাশা। 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন