মাগফেরাত
কামনা করা কতটুকু ধর্মসম্মত ?
কেউ মারা গেলে দেশের ধর্মবেত্তাগণের শিক্ষামতে
মৃতকে উদ্দেশ্য করে পরিবেষ্টিত মোনাজাতে আল্লাহর কাছে তার জান্নাত মাগফিরাত কামনা করা
হয়। কখনও কখনও আত্মা শব্দের স্থলে রূহ শব্দটিও ব্যবহার করা হয়। ব্যতিক্রম ছিল না প্রয়াত
রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের ক্ষেত্রেও। ফলে বিষয়টি ভাবনায়, এরূপ মোনাজাতে ধর্মীয় যৌক্তিকতা
নিয়ে প্রশ্ন তোলাটা জরুরি হয়ে পড়েছে। প্রথমেই দেখা যাক রূহ কি?
আল কুরআনে রূহ্ সম্পর্কে পাওয়া যায় -
* মানুষ আপনাকে রূহ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে,
আপনি বলুন, রূহ আমার প্রভুর নির্দেশ - আল কুরআন, সূরা বনি ইসরাইল।
* আমি তাদেরকে বাহ্যিক জগত এবং তাদের দেহ
ও আত্মার মধ্যে আমার নিদর্শন দেখিয়ে থাকি যাতে সত্যের গুঢ় তত্ত্ব তাদের নিকট প্রকাশ
হয়। (সূরা ইব্রাহীম-রুকু-৬।
* সাধক ইমাম গাজ্জালী (রাঃ) তার কিমিয়ায়ে
সা'য়াদাত গ্রন্থে ‘রূহ’কে আত্মা, পরমাত্মা
বা নফস বলা হয়েছে। তাঁর গবেষণায় আত্মা অনাদি নয় বরং সৃষ্ট গুণময় সত্তা। তার মতে আত্মা
শরীরী পদার্থ নয় কিংবা আত্মা গুণ নয়। তাঁর মতে মানব সৃষ্টির মৌলিক উপাদান দুটি -
১) দৃশ্যমান দেহ এবং ২) অদৃশ্যমান রূহ,
পরমাত্মা বা আত্মা।
দৃশ্যমান পদার্থকে দার্শনিকগণ বলেন, আলমে
শাহাদাত বা চাক্ষুষ জগৎ। আত্মা চাক্ষুষ জগতের অতিথি স্বরূপ, আল্লাহ্র তত্ত্বজ্ঞান
ও সৃষ্ট জগতের সৌন্দর্য্য প্রদর্শন এবং তাঁর মহিমা উপলব্ধি করা আত্মার কাজ।
রূহ বা আত্মা আল্লাহ্র হুকুম বা আদেশ
তাই আল্লাহ্র আদেশ জাত দায়িত্ব বা দায়ভার শরীর নয় বরং আত্মাকেই বহন করতে হয়। পরম করুণাময়
আল্লাহ্ তায়ালাই হলো আত্মার উৎপত্তি স্থল, নশ্বর জগৎ পরিদর্শনের মুসাফির রূপে আত্মার
আগমন। পরিদর্শন শেষে আত্মার প্রত্যাবর্তন হয় আল্লাহ্র দরবারে। তাঁর মতে আত্মা দেহ
রাজ্যের বাদশাহ্ বা তত্ত্বাবধায়ক।
মহাত্মা ইমাম গাজ্জালীর মতে সাধারণের জন্য
আত্মার আলোচনা নয়, বরং বিশেষ ক্ষেত্রেই এ আলোচনা রূহ বা আত্মা সম্পর্কে গবেষক ইবনে
সিনার ধারণা - এ সম্পর্কে তার গ্রন্থ কিতাবুল নাফস এর ইশারত গ্রন্থে বিস্তারিত আলোচনা
করেছেন। তাঁর মতে আত্মা অজড় পরিপূর্ণ বস্তু। আত্মার পরিপূর্ণতাই দেহের পরিপূর্ণতা।
তাঁর মতে ‘আত্মা’ বিমূর্ত বস্তু। (জওহার মানাভী) - তিনি
মনে করেন রূহ বা আত্মা থেকেই শরীরের গঠন ও পরিপূর্ণতা গঠিত হয়। তিনি আত্মাকে জ্ঞানময়
সত্তা বলে অভিহিত করেন। তিনি দেহকে আত্মার সর্বোতভাবে দূষণ মুক্ত অধীন সত্ত্বা বলে
মনে করেন। অজড়-অমর সত্তা। তাঁর মতে আত্মার
সত্তা অন্য কিছু থেকে আসে, দেহ থেকে নয়। তাই দেহের মৃত্যুর পর আত্মার অমরত্ম গুণে আত্মা
পূর্বতন স্থানে ফিরে যায়। হাক্কানী ভাবধারায় আত্মাকে চৈতন্যময় দেহ বলা হয়।
সুতরাং প্রশ্ন হচ্ছে, রূহ কিংবা আত্মার
মাগফেরাত কামনা করা কি আদৌ সঙ্গত, আদৌ গ্রহণযোগ্য? রূহ বা আত্মার কথা বাদ দিলেও যে
প্রশ্নটি সরাসরি তোলা যায় তা হচ্ছে - মাগফেরাত কামনা করার প্রশ্নটি আসে কি করে? প্রয়াত
রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানতো বটেই যে কোন মুসলমানের ক্ষেত্রেই এই প্রশ্নটি তোলা যায়
সঙ্গতভাবেই যে, চলে যাওয়া মানুষটি যার জন্য কামনা করা হচ্ছে মাগফেরাত, তার মাগফেরাত
আদৌ দরকার আছে কি না এটা নির্ধারণ করার, এটা বুঝে নেয়ার আমরা কে? চলে যাওয়া মানুষটি
পাপী বা পূণ্যবান ছিলেন তা নিশ্চিত করে বলার
ক্ষমতা, শক্তি বা অধিকার আমাদের কারো আছে কি? যারা মোনাজাত পরিচালনা করছেন, করে থাকে
অথবা শামীল হন মোনাজাতে তাদের কেউ কি দাবী করতে পারবেন - চলে যাওয়া মানুষটি পাপী ছিলেন
তিনি নিশ্চিত? নাকি বলে বসবেন, দাবী করবেন চলে যাওয়া মানুষটির কাঁধে দায়িত্ব পালনকারী
‘মুনকির-নাকির’ এর সঙ্গে তাদের
যোগাযোগ হয়েছিল, কথা হয়েছে।
সুতরাং কারো আত্মা বা রূহ্কে দূরের কথা
কারো মাগফিরাত কামনা করা এক ধরনের ধৃষ্ঠতা
নয় কি? খোদার হয়ে খোদগারী করা নয় কি?
দেশের ধর্মপ্রাণ মানুষদের সরলতার সুযোগ নিয়ে আমাদের ধর্মীয়
নেতা দাবিদার ধর্মবেত্তাদের ধর্মের নামে এরূপ অপধার্মিকতার চর্চা বন্ধ করা উচিত, প্রকৃত
ধর্মেরই স্বার্থে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন