শ্রমিক সমাজে
আদর্শিক নেতৃত্বের অভাব!
সংলাপ ॥ প্রতিবছরই পালিত হচ্ছে মে দিবস। শ্রমিকদের
ন্যায্য দাবি প্রতিষ্ঠায় রাজনীতিজীবীরা সোচ্চার বক্তব্যও দিচ্ছে। কিন্তু সত্যিকার অর্থে
শ্রমিকদের দাবি-দাওয়া কি কখনই সম্মানিত ও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বা হচ্ছে?
আদর্শহীন শ্রমিক রাজনীতিক শ্রেণীর হাতে শ্রমিকেরা
চিরকালই নিগৃহীত। অথচ এদের শ্রমের বিনিময়েই আজ বাংলাদেশের অর্থনীতি উন্নয়নের ডানা মেলেছে।
বর্তমানে দেশের উন্নতিতে অংশীদারিত্ব থাকলেও শ্রমিক শ্রেণী আজ আর তাদের শ্রেণী স্বার্থে
সোচ্চার হতে পারছে না। জোরদার কোন ভূমিকা রাখতে পারছে না মালিক তথা রাজনীতিক শোষকদের
বিরুদ্ধে। কিন্তু কেন? কেন আজ তারা বিচ্ছিন্ন? নিজেদের দাবি তো নিজেদেরই আদায় করে নিতে
হবে। রাজনীতিকরা বা আদর্শহীন শ্রমিক নেতারা কখনই স্বেচ্ছায় চাইবে না তাদের একচ্ছত্র
প্রভুত্বকে বিসর্জন দিতে।
এ দেশে শ্রমিক শ্রেণী কখনই শ্রেণী স্বার্থ চেতনায়
ঘটাতে পারেনি যথার্থ পরিবর্তন। শ্রমিকদের স্বার্থে গঠিত ট্রেড ইউনিয়ন পরিণত হয়েছে শ্রমিকদের
দাবিয়ে রাখার যাঁতাকলে। নেতৃবৃন্দের কোন্দল, দলীয় ও ব্যক্তিক স্বার্থ, শ্রমিকদের কখনই
মাথা তুলে দাঁড়াতে দেয়নি। দেশ স্বাধীনের পর যখন রাজনীতির ভূত চেপে বসল শ্রমিকদের ঘাড়ে
তখন তারা হারিয়ে ফেললো স্বাধীন সত্তা। রাজনৈতিক ক্ষমতার দলগুলোর লেজুড়বৃত্তি করে চললো
তারা। রাজনৈতিক স্বার্থই তখন তাদের কাছে প্রধান হয়ে গেল। সাধারণ শ্রমিকেরা তাদের আদর্শহীন
রাজনীতির খেলার পুতুলে পরিণত হলো। নিত্যদিন যাদের শ্রম ব্যবহার হচ্ছে তাদের মূল্যায়ন
নেই, নেই ন্যায্য পারিশ্রমিক। তৃতীয় বিশ্বের দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে বহন করতে হচ্ছে
দারিদ্র্য ও নিরক্ষরতার চরম অভিশাপ। বর্তমান নিরক্ষরতার হার প্রায় ৬০.৯%। আর শ্রমিক
শ্রেণীর মধ্যে এই নিরক্ষরতার হার সবচেয়ে বেশি। অক্ষরজ্ঞান সম্পন্ন না হওয়ায় সত্য ও
আদর্শের পথে তারা সচেতন হতে পারছে না নিজের অধিকার সম্পর্কে। ফলে খুব সহজেই তারা প্রতারিত
হচ্ছে রাজনৈতিক দলের দালাল শ্রেণীর হাতে।
দেশের প্রতিটি ক্ষেত্রেই আজ শ্রমিকেরা নিষ্পেষিত।
দেশের সবচেয়ে সম্ভাবনাময় এবং প্রধান ক্ষেত্র কৃষিতে কর্মরত শ্রমিক শ্রেণী চরম অবহেলিত।
দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৬৩% লোক এই কৃষি কর্মের সাথে জড়িত। কিন্তু কোন সরকারই এই
কৃষিকে উন্নত করতে বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তি, বিদ্যুৎ ও সার ব্যবহারকে নিশ্চিত করেনি। বরঞ্চ
প্রাকৃতিকভাবে এবং মহাজন, ফড়িয়া ও ব্যবসায়ীদের দ্বারা তারা বঞ্চিত হচ্ছে ফসলের ন্যায্য
পাওনা ও দাম থেকে। কৃষিখাত থেকে বঞ্চিত শ্রমিকেরাই একদিন পা বাড়ায় শহরে। কাজ নেয় বিভিন্ন
শিল্প, কল-কারখানায়। কিন্তু সেখানেও তারা শোষণের শিকার। শিল্প-কারখানার মালিকেরা ধার
ধারে না শ্রম আইনের। অধিক শ্রম খাটিয়ে অধিক মুনাফা অর্জন থাকে তাদের একমাত্র লক্ষ্য।
তারা কখনই শ্রমিক শ্রেণীর স্বার্থকে প্রাধান্য দেয় না।
দেশের বর্তমান সর্বাধিক বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী
খাত হচ্ছে পোশাক শিল্প। প্রায় ৬০% বৈদেশিক মুদ্রা আসে এই খাত থেকে। এই খাতে দেশের প্রায়
২০ লক্ষ শ্রমিক কাজ করে। এইসব শ্রমিকদেরও নানাভাবে বঞ্চিত করা হয় ন্যায্য মজুরি থেকে।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার নির্ধারিত মজুরি ব্যবস্থা কোথাও মেনে চলা হয় না। অথচ দেশে
রয়েছে শ্রম অধিদপ্তর। শ্রমঅধিদপ্তর দেশ ও শ্রমিকশ্রেণীর নৈতিক স্বার্থে কাজ করে না। টাকার লোভে মুনাফাখোর
মালিক শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষার্থেই তারা নিবেদিত। শ্রমআইন ও আদালত থাকা সত্ত্বেও শ্রমিক
শ্রেণীর স্বার্থ আজ উপেক্ষিত।
সবক্ষেত্রে ট্রেড ইউনিয়নের দ্বারা শ্রমিকেরা প্রতারিত
হয়েও প্রতিকারের কোন পথ তারা আজও সৃষ্টি করতে পারেনি। রাজনৈতিক স্বার্থেই তারা বন্দি।
মে দিবসে শ্রমিকদের নিজস্ব শ্রেণীগত অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি এবং তা প্রতিষ্ঠায়
অঙ্গীকার একান্ত প্রয়োজন থাকলেও তারা তা করতে পারছে না কারণ ওই দিনটাতেও দারিদ্র্যের
কষাঘাতে ও সাময়িক লাভের জন্য নিজেদের বিক্রি করে দিয়ে আদর্শহীন রাজনীতিকদের সভায় হাজির
হয়ে স্লোগান দিচ্ছে - ‘দুনিয়ার মজদুর এক হও’। মে দিবস উদযাপন সভায় হাজির হওয়ার জন্য
তারা ৪০০-৫০০ টাকায় বিক্রি হয়। তাদের ভয় দেখানো হয় যদি হাজির না হয় তাহলে রাজনৈতিক
চক্রের হাত থেকে মুক্তির সনদ তারা কোনদিনই অর্জন করতে পারবে না। রাজনৈতিক স্বার্থের
তল্পিবাহক মিথ্যাচারের ট্রেড ইউনিয়নের কবল থেকে এখনই বের করে আনতে হবে শ্রমিক শ্রেণীকে
এবং তার জন্য চাই সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত আদর্শিক রাজনৈতিক নেতৃত্ব।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন