বৃহস্পতিবার, ২২ ডিসেম্বর, ২০১৬

সময়ের সাফ কথা.... বাঙালি রেঁনেসা কতদূর কোন পথে?

সময়ের সাফ কথা....

বাঙালি রেঁনেসা কতদূর কোন পথে?

বিজয় আমার বিজয় তোমার
বিজয় ভালবাসার
সকল প্রাণে প্রেম জাগানিয়া সকল কিছু আশার
এই তো আমি এই তুমি এই আমাদের দেশ
সবাই যখন বলতে পারে বিজয় অনিশেষ ॥
নজরুল ইশতিয়াক ॥  মুক্ত প্রাণই কেবল জানে মুক্তির আনন্দ। সে আনন্দ আকাশে বাতাসে ধ্বনিত হয়। মানুষের মর্যাদা সমাজ রাষ্ট্রের সর্বত্র প্রতিষ্ঠা করতেই হয় আজ অথবা কাল। এটা যারা যত আগে বোঝে ততই দেশ-জাতির মঙ্গল হয়। জনগণের দেশে জনমানসের সংস্কৃতির চাষ এবং তার নবায়নের মধ্যে সব পারদর্শিতা, উন্নয়নতত্ত্ব, কাঙ্খিত লক্ষ্য পূরণের পথরেখার সন্ধান মিলে। গাছের গোড়া ঠিক না করে গাছের মাথায় রঙ বাহারি বেলুন, জরি, মালা ঝুলিয়ে বিভ্রান্ত করা যায় তাতে কোন কাজ হয় না। ছোটখাট ঝড়ে তা টলে পড়ে। শেকড়বিহীন গাছ দাঁড়িয়ে থাকে না। তেমনি মানুষময় দেশ গঠনই মূল কথা। একটি জাতি ক্রমশ তার জাতিসত্ত্বার উৎস সন্ধানে আত্মনিয়োগ করার মধ্য দিয়েই সঞ্জিবনী সুধা পান করে এগিয়ে যাবে। বিশ্বের যে সব জাতি বিপন্ন হয়েছে, হারিয়ে গেছে, বিলুপ্ত হয়েছে, পরাধীনতার শিকলে বাধা পড়েছে, তার কারণ তারা তাদের জাতীয় পরিচয়কে ধরে রাখেনি। একটি জাতিসত্ত্বা যেমন গড়ে উঠে দীর্ঘ ধারাবাহিক আচার-শিষ্টাচার আবিষ্কার, সংস্কার, সম্মিলনের মধ্য দিয়ে, স্ব-স্ব কীর্তিমান আদর্শিক ব্যক্তিত্বদের উর্দ্ধে তুলে ধরে তেমনি পতনও হয় সে সব ভুলে যাবার মধ্য দিয়ে।
ইউরোপে রেঁনেসা সংগঠিত হয়েছে মানুষের মহীমা কীর্তনের মধ্য দিয়ে। দেশ ও জাতিগত এ ঐক্যের মূল রচনা করে গেছে ইউরোপের সৃষ্টিশীল মহান মানুষেরা। কৃতজ্ঞচিত্তে তাদের কর্মের প্রতি আস্থাশীল বিশ্বাসীরা এসব স্বীকার করেছে, চর্চা-চর্যার পথে এগিয়েছে। আর এ কারণেই ঐক্যবদ্ধ হবার পথে একে অপরে মিলে-মিশে সব সংকট মোকাবেলায় পারস্পরিক জানা বোঝার পথে এগিয়েছে। সৃষ্টিশীল মানুষের কর্মকে ধরেই সৃষ্টি প্রাণ পায়। সমাজের প্রতিটি অংশ ক্রিয়াশীল হয় সৃষ্টির বন্যায় কাঁপন ঝরাতে ঝরাতে এবং তা জাতির জন্য প্রধান চিন্তনের বিষয়বস্তু হয়ে পড়ে। মানুষ তো মানুষের কাছেই শিক্ষা পায়। মহত মানুষের রঙে রঞ্জিত হয়। সেই মহৎ মানুষের শিক্ষা নিয়ে নিজেকে জানতে পারে, জানতে পারে অন্য সব কিছুকে। আমাদের দেশও এগিয়েছে কর্মনির্ভর গতিশীল মানুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে। অনুসন্ধানী চোখে ধরা পড়বে আমাদের এগিয়ে চলার পথে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন সাধারণ মানুষের মধ্যে থেকে উঠে আসা মহান সব মানুষেরা। হাজার বছরের বাঙালির ইতিহাস সেই সত্যকেই তুলে ধরে। বিশেষ করে আঠার ও উনিশ শতকের পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে সৃষ্টিশীলতার নির্যাস। জাতিগত চিন্তার প্রতিফলন উন্মেষ সাধন সবই সংগঠিত হয়েছে। জাতীয় পরিচয়ের নিক্তি তার রং-রূপ-আদর্শের পথরেখা।
কিন্তু বুঝে হোক আর না বুঝে হোক নাগরিক বৃত্তশালী রাজশক্তি সেগুলো যথাযথভাবে মূল্যায়ন করতে ব্যর্থ হয়েছে নিজেদের সংকীর্ণতার কারণেই। ফলে জাতি হিসেবে বহুপথ পাড়ি দিয়ে অবাস্তব কল্পনার আবর্তে আবার ততটাই পিছিয়ে গেছে। অন্ধকারে উদ্ভাসিত আলোর পথে না হেঁটে আবারও গহীন তিমিরেই আশ্রয় খুঁজে পেতে মরিয়া হয়েছে।
মানুষের শক্তি থাকে তার চিন্তা-চেতনায় অনুভূতি-উপলব্ধিতে। সত্য-মিথ্যা, ভাল-মন্দ, ন্যায়-অন্যায়, প্রতারণা-প্রবঞ্চনা বুঝে উঠার ক্ষমতার মধ্যে, মানবিক সৌন্দর্য জীবনের উদ্দেশ্য দায়-দায়িত্ব কর্তব্যের মধ্যে। অন্ধকারে যতই অট্টহাসি দেয়া হোক তা অন্ধকারেই হারিয়ে যায়। যাদের আমরা বন্দনা করি, গুণকীর্তন করি সবই দারুন এক আনুষ্ঠানিকতার ঘেরাটোপে আটকা পড়েছে। লোক দেখানোর মহোৎসব চলছে অথচ নিজেরাই তা দেখি না। রাষ্ট্রের যে সব প্রতিষ্ঠান শিল্প সংস্কৃতির বিকাশ ঘটাবে, গুণী মহৎ মহাজনদের জন্য কাজ করবে, তারা কেবলই নেতা, মন্ত্রী, উচ্চ কর্তাদের দৃষ্টি আকষর্ণের জন্য বড় বড় ফেষ্টুন ব্যানারের কাজের মধ্যে রয়েছে। গুণীজনদের যথেচ্ছাচার ব্যবহারের সাথে যোগ হয়েছে বড় বড় কোম্পানীগুলোর বাণিজ্যিক যোগ। সরকারী বেসরকারী সব ক্ষেত্রে রোগ প্রকট হয়েছে। ফলে গুণীজনদের আশ্রয় পেতে এসে নিজের জনপ্রিয়তা নিজের আর্থিক প্রতিষ্ঠা মূখ্য হয়ে উঠেছে। বঙ্গবন্ধুর নামে কত কিছুই না করা হচ্ছে; যারা করছে তারা কেউই বাংলার প্রকৃত বন্ধু হতে চান না। কেবলই ভুঁইফোড় ছোটাছুটি সার। অনেকটা এমন নিজে কানা পথ চেনে না পরকে দেখায় বারেবার। দেশে গুণীদের কদর কদাচিৎ আছে সভা, সেমিনারে, রেফারেন্সে পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে। অন্য কোথাও তাদের মূল্যায়ন করা হয়না। দিক্-নির্দেশনাকে মানা হয় না। যারা এটি বাস্তবায়ন করবে তারা এগুলোকে পাঠ্যসূচীর অংশ ছাড়া আর কিছুই মনে করেন না। ফলে যা হবার তাই হচ্ছে। পরিস্কারভাবে বললে যে দু’একজন গুণীর কথা বাজারে আছে তার নেপথ্যে বাজারীপনা ছাড়া অন্য কোন কিছুর অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাবে না। কিছু কিছু নামে সবাই গগনবিদারী ধ্বনি তোলেন কিন্তু তাদের জীবনে সে ধ্বনির কোন প্রতিফলন নেই। গুণীজনের মধ্যে থাকে গুণের সমাহার। প্রত্যেকটি নামই এক একটি আদর্শের নাম। প্রত্যেককেই বিশেষ বিশেষ বিশেষণে বিশেষায়িত করা যায়। সবকিছুর উর্দ্ধে ব্যক্তিত্বই প্রধান হয়ে উঠে। ব্যক্তি যখন ব্যক্তিত্বের আদর্শে পরিণত হন তখন তার নামই সবকিছুর উর্দ্ধে চলে আসে। তাদের কর্মের বন্দনার সাথে সাথে সমানভাবে নাম কীর্তন হয়।
বাঙালির প্রাণপুঁরুষরা এই জাতিকে তার নিজস্ব জাতিসত্ত্বায় পরিণত করেছে। আজকের যে বাংলাদেশ মাথা তুলে দাঁড়িয়ে তা তো তাদেরই অবদান। নিরবে নিভৃতে সে সব ব্যক্তিত্বরা তুলে ধরেছেন বাঙালির জাতিসত্ত্বার পতাকা। হাল আমলে শেখ হাসিনা পরিণত হয়েছেন অনুকরণীয় অনুস্মরণীয় দারুন ব্যক্তিত্বে। দেশের প্রধানমন্ত্রী, দলের সভানেত্রী, বঙ্গবন্ধু কন্যা, দেশরত্ন, জননেত্রী সব পরিচয় বিশেষণ ছাপিয়ে তিনি শেখ হাসিনা। তিনি সাহসী, উদ্যমী, অকুতোভয়, দৃঢ়চেতা, ন্যায় পরায়ণ, পরিশ্রমী। তিনি বিশ্বব্যাংক সংস্কার চেয়েছেন; বলেছেন বিশ্বব্যাংকের আধুনিকায়ণ দরকার। তিনি বলেছেন যে উদ্দেশ্য নিয়ে এটি যাত্রা শুরু করেছিল তা পালনে ব্যর্থ হয়েছে। পরামর্শ আর অপকৌশলী ভূমিকার কারণে বিশ্বব্যাংক দরিদ্র দেশগুলোর জন্য কার্যত কিছু করছে না। তিনি শান্তি সুরক্ষায়, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুকি মোকাবেলায় জাতিসংঘের কার্যকর ভূমিকার দাবি তুলেছেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে নিবেদিতপ্রাণ ত্যাগী পরিশ্রমী শেখ হাসিনা গুণীজনদের কর্মকে সমাজে প্রতিটি অধ্যায়ে ছড়িয়ে দেবার আহবান জানিয়েছেন। তাদের আদর্শে দলীয় নেতা কর্মীদের আদর্শে পরিণত করার তাগিদ দিয়েছেন। শেখ হাসিনা দৃঢ়তার সাথে বলেছেন-সততাই আমার শক্তি, সততাই আমার সৌন্দর্য, সততাই আমার সাধনা।
মানুষে মানুষে দূরত্ব কমানোর মানবপ্রেমের কর্মসূচী দেশরত্নকে উচ্চতায় আসীন করেছে। তিনি বারবার গুণীজন, সৃষ্টিশীল মহান দিক্নির্দেশক ব্যক্তিত্বদের মতো জীবনাদর্শ গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়ে যাচ্ছেন। দেশরত্নের এসব আবেদন দলের নেতা কর্মীকে কতটুকু অনুপ্রাণিত করেছে? তারা ব্যক্তি জীবনে কর্মী সমর্থকদের সাথে দিক্নির্দেশক সে সব আহ্বান নিয়ে কাজ করছেন? দারিদ্র বিমোচন তথা অভাব অভিযোগ দূর করাতো সদিচ্ছা, সততার উপর নির্ভর করে।
মানুষের দেশে মানুষের চাষ হবে এটাই তো সত্য। সমাজের সর্বত্র মানুষের দেখা মিলবে, তবেই তো মিলবে মানুষে মানুষে, হবে মহীয়ান। তাদেরকেই অনুকরণ অনুস্মরণ করবে নতুন প্রজন্ম। মানুষকে না ধরে টাকা পয়সা বৃত্ত বৈভব খ্যাতি পান্ডিত্য ক্ষমতা লুটপাটকে যারা উপজীব্য করেছেন তারা সে সবের স্তুপে চাপা পড়বে এতে কোন সন্দেহ নেই।

আমরা কি শেখ হাসিনার উচ্চতা অনুধাবনে সক্ষম। ব্যক্তিস্বার্থের উর্দ্ধে উঠে দল ও দেশকে স্থান দিতে পেরেছি ? বঙ্গবন্ধুর ত্যাগ কি নিজের জীবনে প্রতিষ্ঠা করেছি? ভাসানী-তাজউদ্দীন-নজরুল-রবীন্দ্রনাথ-লালন-জয়নুল-সুলতানের রঙে কি রঞ্জিত হতে পেরেছি? চেতনার কোথায় বিজয় অনুরণন তোলে, কোথায় বৈশাখের কাঁপন শিহরণ জাগায়, কোথায় বন্ধুত্ব সেতু বন্ধন গড়ে দেয়? প্রেম মর্যাদা কাছে টানে? এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজা হচ্ছে না। বরং নিজেদের অজান্তেই এগুলোকে আমরা নির্বাসন দিয়েছি, বাতিল কাল্পনিক অবাস্তবের অভিধায় অভিহিত করেছি। শক্তি সৌন্দর্যের উৎসকে চিহ্নিত না করেই ছুটছি। ফলাফল যা হবার তাই হচ্ছে। বিভাজন, বিভেদ, দূরত্ব বাড়ছে। ষড়যন্ত্র, প্রতিহিংসা, রুগ্নতা, রুক্ষতা বর্বরতা সবকিছু ছাপিয়ে মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে। ব্যক্তি জীবনে মহান মহৎ সৃষ্টিশীলতাকে স্থান না দিলে সে আলোয় আলোকিত না হলে দিক্নির্দেশক ব্যক্তিত্ব হবার কোন সুযোগ নেই। দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে নিজেকে নিজের উপর, তারপর অন্যের উপর। আমরা অন্যকে হতে বলি, করতে বলি, নিজেরা তা করি না। যে সত্য, যে আলো, যে রঙ নিজেদেরকেই স্পর্শ করেনি তা অন্যে বললে কেমন করে স্পর্শ করবে? রাজনীতির নামে, জনপ্রশাসন সেবার নামে যা করা হচ্ছে তার আবেদন সমাজে নেই। মানুষের দেখানো পথে মানুষ এগিয়ে যাবে। মানুষকে বড় করে মানবতাকে উর্দ্ধে তুলে ধরার এই তো সময়। তবেই তো আসবে বাঙালির রেঁনেসা। 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন