মঙ্গলবার, ৭ জুন, ২০১৬

যে সৃজনশীলতায় সত্য নেই

যে সৃজনশীলতায়সত্য নেই

শাহ্ শাহনাজ সুলতানা ॥ ২০০৯ সালে কোমলমতি প্রাথমিক পর্যায়ের ছাত্র-ছাত্রীদের মেধা, পারিপার্শ্বিক অবস্থা, শিক্ষার মান না ভেবে এবং কোন ধরণের গবেষণা ছাড়াই প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষার ব্যবস্থা করেছিলো বাংলাদেশ সরকার। সে সময়ের একজন ভুক্তভোগী অভিভাবক হিসাবে খুব কাছে থেকে দেখেছিলাম এক শিক্ষাথীর্র অসহায় অবস্থা! বছরের প্রথম তিন মাস শিক্ষার্থীরা জানতেই পারেনি তাদের প্রশ্ন পদ্ধতি কেমন হবে? বিশেষ করে গণিত এবং ইংরেজী বিষয়। এরপরে ছিলো গোদের উপর বিষ ফোঁড়ার জ্বালা আর তা হলো প্রশ্নপত্র ফাঁস। মেয়ে প্রশ্ন করেছিলো - এত পরিশ্রম করলাম, কি লাভ হলো? এই প্রশ্নের কোন যুৎসই উত্তর দিতে পারিনি সেদিন। শুধু এতটুকুই বলেছিলাম - বই পড়লে বিফলে যায় না।
সম্প্রতি একটি বেসরকারী টেলিভিশন চ্যানেলে এক সাংবাদিকের কিছু মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের সাথে সাক্ষাৎকার মূলক প্রতিবেদন নিয়ে সামাজিক গণমাধ্যমে চলছে তোলপাড়। ফেসবুকে তা হয়েছে ভাইরাল। শিক্ষার্থীদের প্রশ্ন করা হয়েছিলো কিন্তু উত্তর তারা দিতে পারেনি। তাদের জিজ্ঞেস করা হয়েছিল পীথাগোরাস কে? শিক্ষার্থীরা জবাবে বলেছিল তিনি একজন ঔপন্যাসিক। তাদের জিজ্ঞেস করা হয়েছিল বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির নাম, রাজধানীর নাম কিন্তু তারা তা বলতে পারেনি। তাদের জিজ্ঞেস করা হয়েছিল জাতীয় সঙ্গীতের রচয়িতা কে? তাদের একজন জবাবে বলেছে - কাজী নজরুল ইসলাম। বাকিরা কেউ জবাব দিতে পারেনি। জিপিএ ফাইভ পাওয়া একজন ছাত্রীকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো -‘আমি জিপিএ ৫ পেয়েছি এর ইংরেজী অনুবাদ কি’? উত্তরে বলেছে - ‘আই এম ফাইভ’। জানতে চাওয়া হয়েছিলো- ‘আমাদের রণসঙ্গীত কোনটি? তারা জানেনা বলে জবাব দিয়েছে।
কে লিখেছেন রণসঙ্গীত? তাও তারা জানেনা। বিজ্ঞানের ছাত্রের নিকট নিউটনের সূত্র জানতে চাওয়া হয়েছিলো-উত্তর জানেনা। এ নিয়ে চলছে পাল্টা মতামত দেয়ার প্রতিযোগিতা। একপক্ষ বলছে - সাংবাদিক সাহেব যা করেছে ঠিক করেছে। আরেক পক্ষ বলেছে - এভাবে গণমাধ্যমে ছেলেমেয়েদের ছবি দেখানো ঠিক হয়নি; এতে তাদের মনোজাগতিক সমস্যা হতে পারে! 
গল্পটা এখানেই শুরু। বছর কয়েক আগে প্রখ্যাত কথা সাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদ রচিত ও পরিচালিত একটি নাটক দেখেছিলাম। গ্রামের সহজ-সরল স্কুল পাস দেয়া এক ব্যক্তির সাক্ষাৎকার নেয়া হবে। কি কি প্রশ্ন করা হবে তা আগে থেকেই শিখিয়ে পড়িয়ে দেয়া হলো। সবকিছু প্রস্তুত। লাইট  ক্যামেরা  অ্যাকশান বলতেই দেখা গেল লোকটির মুখ দিয়ে কোন আওয়াজই বের হচ্ছে না। উনি বোবা হয়ে গেছেন। দ্বিতীয় দফা জিজ্ঞেস করা হলো - আপনি কি ভয় পাচ্ছেন? লোকটি দৃঢ়তার সাথে বললো - এতে ভয় পাওয়ার কি আছে? এইটা তো কোন ব্যাপারই না। আবার লাইট ক্যামেরা অ্যাকশান। আগের মতই ফ্যালফ্যাল করে ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে আছেন উনি। লা জবাব। এই হলো ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলার যোগ্যতা ও সাহস! অনেক গুছানো কথা অগুছালো হয় বা হয়ে যায়! মাত্র ১২ থেকে ১৩ জন ছাত্রছাত্রী নিয়ে যে সচিত্র প্রতিবেদন সাংবাদিক দেখিয়েছেন তাতে ক্ষতি ছাড়া কোন লাভ দেখছি না।
পত্রিকায় প্রকাশিত সূত্র মোতাবেক চলতি বছরে ১৪ লাখ ৫২ হাজার ছাত্রছাত্রী মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে। এদের মধ্যে ৭ লাখ ১১ হাজার মেয়ে। ১২ বছরের শিক্ষাজীবনে একজন শিক্ষার্থীকে মোট ৪ টি পাবলিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে হয়। যা একমাত্র বাংলাদেশে চালু আছে। পরীক্ষার রেজাল্ট বের হলে (আগে বলা হতো ফল) ছেলে-মেয়েদের ভি চিহ্ন দেখানো, ঢোল পেটানো সবই দেখি। কিন্তু কোথায় যেন একটা গড়মিল থেকে যাচ্ছে। বরেণ্য শিক্ষাবিদ ড. জাফর ইকবাল গত ২৬ মে সিরডাপ মিলনায়তনে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আয়োজনে ‘মাধ্যমিক শিক্ষার মানোন্নয়নে করণীয়’ শীর্ষক মতবিনিময় সভায় বলেন - ‘নবম শ্রেণীর বিজ্ঞান বই আমিই বুঝিনা, ছাত্ররা বুঝবে কি করে? (সূত্রঃ বাংলা মেইল ২৪.কম, ৩ জুন ২০১৬)। মতবিনিময় সভায় উপস্থিত ছিলেন শিক্ষামন্ত্রী, অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, ড. ফরাস উদ্দিন, অধ্যাপক মোহাম্মদ কায়কোবাদ, সুলতানা কামাল, রাশেদা কে চৌধুরী প্রমুখ। ড. জাফর ইকবাল আরো বলেছেন, ‘এমসিকিউ তুলে দেয়া উচিত! এর কোন প্রয়োজনীয়তা নেই!’ দেশের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদদের সমন্বয়ে অনুষ্ঠিত এই মতবিনিময় সভা থেকে জাতি কি কিছু পাবে? নাকি বিনিময় পর্যন্তই সার!
সৃজনশীল পদ্ধতি চালু করা হয়েছিলো বিশিষ্ট শিক্ষাবিদদের নিয়ে একটি বিশেষ কমিটি মাধ্যমে। কিন্তু এর বর্তমান পরিস্থিতি কি তা জানা দরকার এবং এর গভীরে যাওয়া দরকার। খোদ রাজধানী কিংবা বিভাগীয় পর্যায়ের সেরা প্রতিষ্ঠানগুলো হাতে গুণে লাভ নেই। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দিকে তাকিয়ে প্রকৃত সত্য বের করে নিয়ে আসা দরকার এখনই। শিক্ষার্থীরা বইমূখী হবে এই চিন্তা করেই সৃজনশীল পদ্ধতি চালু করা হয়েছিলো। শিক্ষার্থীরা মুখস্ত বিদ্যা নির্ভর হবেনা। চিন্তা করার একটা ক্ষেত্র তৈরি করার জন্যই এ পদ্ধতি চালু করা হয়েছিলো। অথচ বিশিষ্ট শিক্ষাবিদরাই আজ বলছেন - সৃজনশীল পদ্ধতি শিক্ষকরাই বুঝে না। প্রশ্ন থেকেই যায় - কেন এ পদ্ধতির ভালো-মন্দ দিক শিক্ষকদের মগজের মধ্যে না ঢুকিয়ে চালু করা হলো ?
শিক্ষা বিষয়ক মনোবিজ্ঞানী বেঞ্জামিন ব্লুম ১৯৫৬ সালে একটি হাতবই বের করেন। এতে তিনি নিম্নতর চিন্তার স্তরকে ৩ ভাগে ভাগ করেন। জ্ঞান, অনুধাবন, ও প্রয়োগ। উচ্চতর চিন্তার স্তরকে ৩ ভাগে ভাগ করেন। বিশ্লেষণ, সংশ্লেষণ ও মূল্যায়ণ। ২০০১ সালে ব্লুমের ছাত্র লরিন এন্ডারসনের নেতৃত্বে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা হয়। তারা চিন্তার স্তর গুলো ঢেলে সাজান এবং নামবাচক শব্দের পরিবর্তে ক্রিয়াবাচক শব্দ প্রয়োগ করেন। যেমন: জ্ঞান - মনে করা বা স্মরণ করা; অনুধাবন - বুঝতে পারা; প্রয়োগ - প্রয়োগ করা; বিশ্লেষণ - বিশ্লেষণ করা; সংশ্লেষণ - মূল্যায়ণ করা; মূল্যায়ণ - সৃষ্টি করা।
সৃজনশীল পদ্ধতিতে পাঠ্য বই থেকে একটি অনুচ্ছেদের সাথে মিল রেখে বাইরের কোন বই থেকে, গল্প কিংবা কবিতা থেকে অংশবিশেষ নিয়ে তৈরী করা হয় উদ্দীপক। উদ্দীপক অনুসারে জ্ঞান, অনুধাবন, এবং প্রয়োগ এই তিন স্তরের উপর ভিত্তি করে প্রশ্ন সাজানো হয়। যার জন্য দরকার অনুশীলন। আগের মতো ৫ বছরের বোর্ড প্রশ্ন ঘাটলেই বড় প্রশ্ন, ছোট প্রশ্ন বা ব্যাখ্যা কমন পড়বে - সে দিন আর নেই। পাঠ্য বইয়ে আছে জীবনানন্দ দাশের কবিতা -
‘আবার আসিব ফিরে ধানসিড়িটির তীরে এই বাংলায়,
হয়তো মানুষ নয় - হয়তোবা শঙ্খচিল শালিকের বেশে
হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে
কুয়াশার বুকে ভেসে একদিন আসিব এ কাঁঠাল ছায়ায়’।
উদ্দীপক :
‘গাঁয়ের ধারে বিলের পারে পদ্মভরা জলে
শাপলা শালুক কলমি কমল সবুজ থরে ফলে
সেথায় চরে হাজার পাখি নিতুই দিবস ভর,
সাঁঝের মায়ায় কল্পপুরীর নামে তেপান্তর।”
প্রশ্ন থাকছে এরকম : জীবনানন্দ দাশের আবার আসিব ফিরে এবং উদ্দীপকের সাথে কি সাদৃশ্য আছে - বিশ্লেষণ কর।
এখানে এসে ছাত্ররা খেই হারিয়ে ফেলছে। কারণ অনুধাবন মানে বুঝতে পারা। শিক্ষার্থীকে পাঠ্যবই পড়তে হবে। বুঝতে হবে এবং সৃষ্টি করতে হবে। কিন্তু বাস্তবে কী ঘটছে? কোচিং ও গাইড বই নির্ভর জীবনকে কেন্দ্র চলছে তাদের শিক্ষাজীবন। এককথায় সবকিছু অচল। সৃজনশীল তৈরি করছে গাইড প্রণেতারা, বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা নয়। আর করলেও তাদের  কাছে প্রাইভেট যারা পড়ে তারা অতি সামান্য হলেও সুবিধা পায়। বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কাছে পড়ার জন্য সরাসরি বলা হয় আজকাল। প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা ও জেএসসি পরীক্ষার সময় অধিকাংশ বিদ্যালয়ে কোচিং করা করানো হয়। এর জন্য আলাদা ফি দিতে হয় বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে। কোচিং ঠিকঠাকমত হলে অভিভাবকগণ বাইরের কোচিং সেন্টারে সন্তানকে দিতেন না। এটাও পর্যাপ্ত না। এরপর চলে বাসায় আলাদা করে শিক্ষক রেখে বিষয়ভিত্তিক পড়ার সমস্যাগুলো দূর করা। এটা কি সব ছাত্রছাত্রীর জন্য সম্ভব? মডেল টেস্ট এর নামে চলে অর্থ কামানোর মহোৎসব। এই মহোৎসবে যোগদান না করলে নিবিত্তের একটা মেধাবী মেয়ে কিংবা ছেলে কখনোই ভালো রেজাল্ট করার আশা করতে পারে না। কারণ: প্রশ্ন পদ্ধতির ধরণ। শুধুমাত্র রাজনৈতিক কুটকৌশলের কারণে (চিন্তার একমুখীতা যেখানে নেই) শিক্ষারমান কোথায় যেতে পারে তার ছোট্ট একটা নমুনা বেসরকারী টেলিভিশনের ওই সাংবাদিক সাহেব (!) দেখিয়ে দিলেন। সরকারী অনুদানপ্রাপ্ত  প্রত্যেক বিদ্যালয়ের কমিটিতে থাকেন সম্মানিত সংসদ সদস্যগণ। তাদের মধ্যে অনেকের কার্যকলাপ কত সুন্দর তা প্রতিদিনের সংবাদ পাঠ করলে জানা যায়। এমন সোনার মানুষ পাওয়া সত্যিই ভাগ্যের ব্যাপার যিনি রাজনীতির সাথে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে ট্রাম্প কার্ড হিসাবে নেন না।
সুতরাং যারা দেশের রাষ্ট্রপতির নাম জানেনা বা বলতে পারেনি তাদের দোষ দেয়া যায় না। সেই পরিবেশ দিতে আমরা ব্যর্থ হচ্ছি। যে পরিবেশে তারা শুধু একজন পরীক্ষার্থী হবে না, তারা হবে সত্যিকারের একজন শিক্ষার্থী। বানিজ্যিকীকরণের খাতায় নাম লিখিয়েছে - জিপিএ ফাইভ। জিপিএ ফাইভের সংখ্যা যত বেশী সে বিদ্যালয়ের সুনাম তত বেশী। ছাত্ররা বই পড়–ক বা না পড়ুক। বিদ্যালয়ের পাশে আরেকটি প্রতিষ্ঠান - বিদ্যালয়ের ছায়া বেনামে। সেই ছায়া বিদ্যালয়ে চলছে রমরমা শিক্ষা ব্যবসা। তার নাম কোচিং সেন্টার (কোথাও এই শব্দের বাংলা ব্যবহার দেখা যায় না)। সরকারের সেবামূলক কাজে রাষ্ট্রীয় পুরস্কারের পদটি কোচিং সেন্টারের মালিকদের দেয়া দরকার। কারণ তারা সেবা দিচ্ছে। কি সেবা যে তারা দিচ্ছে তা একমাত্র জানেন অর্থ প্রদানকারী অভিভাবকরা। 
আমরা নিরাশাবাদী নই। আমরা চাইনা আমাদের ছেলেমেয়েরা বিবেকহীন ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হোক। তারা মানুষের মতো মানুষ হোক। তাদের মধ্যে জানার প্রতি আগ্রহ তৈরীর কাজটি করবে সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষিকা। বলার অবকাশ নেই এতে মা বাবার ভূমিকা মুখ্য। যে মা সারা দিন জি সিনেমা বা  স্টার জলসার সিরিয়ালের মধ্যে ডুবে থাকে তার ছেলে মেয়েরা রাষ্ট্রপতির নাম বলতে  না পারলে অসুবিধা নেই। কারণ যারা এই সিরিয়াল নামের নেশার মধ্যে থাকে, তাদের কাছে বাংলাদেশের রাজধানী নেপাল বা ঢাকা  দুটোর মধ্যে একটা হলেই তো হয়! নেশা বলে কথা!
মূল্যায়ণ মানে বিচার করার ক্ষমতা এবং এটা অর্জন করতে হয়। যে অর্জন নতুন কিছু সৃষ্টি করার সহায়ক শক্তি হয়। মূল্যায়ণ করি কাকে? আমাকে মানে অভিভাবককে? বিদ্যালয়ের বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থাকে? শিক্ষকের ভুমিকাকে? রাজনীতির কুটচালকে? নাকি বিশিষ্ট শিক্ষাবিদদের উর্বর মস্তিষ্কের নিষ্ফলা চিন্তাকে যেখানে নেই কোন গবেষণা?
আমরা সবসময় আশার বাণী পাই। সাধক নজরুল ইসলাম যেভাবে বলেছেন -
‘আবার কি আঁধি এসেছে, হানিতে
ফুলবনে লাঞ্ছনা?
দু’হাত ভরিয়া ছিটাইছে পথে
মলিন আবর্জনা।
করিওনা ভয়, হবে হবে লয়
আপনি এ উৎপাত।’

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন