বৃহস্পতিবার, ২১ এপ্রিল, ২০১৬

প্রতিবাদের ভাষা বিনির্মাণে....



প্রতিবাদের ভাষা বিনির্মাণে....

অ্যাডভোকেট এম.মাফতুন আহম্মেদ ॥ কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার কবিতায় লিখেছেন - ‘যদি কেউ কথা না কয়, ওরে ও অভাগা, যদি সবাই থাকে মুখ ফিরায়ে, সবাই করে ভয়, তবে পরাণ খুলে ও তুই মুখ ফুটে তোর মনের কথা একলা বল রে’। সবাই যদি বাংলার জমিন থেকে হারিয়ে যান, ভয়ে সন্ত্রস্ত্র হন, নির্বাক হয়ে যান, আতংকে প্রতিবাদের ভাষা হারিয়ে ফেলেন, একলা চলেন, একলা মনের কথা বলেন তাহলে জাতি হিসেবে আমাদের কী একদিন অস্তিত্ব সংকটে পড়তে হবে? 
কারণ শহীদ-গাজীদের দেশ প্রিয় বাংলাদেশ। আন্দোলন-সংগ্রামের দেশ বাংলাদেশ। প্রতিবাদের দেশ বাংলাদেশ। লাখো শহীদের রক্তে ভেজা লাল সবুজের পতাকায় আচ্ছাদিত বাংলাদেশ। ইতিহাস-ঐতিহ্যের দেশ বাংলাদেশ। এই উপমহাদেশের প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামের সূতিকাগার সবুজ-শ্যামল এই বাংলাদেশ। অগ্নি গর্ভ বাংলাদেশ। বাঙালিদের অতীত ইতিহাস রয়েছে। ঐতিহ্য রয়েছে। নিজস্ব সংস্কৃতি রয়েছে। স্বাতন্ত্রতাবোধ রয়েছে। তারা অধিকার আদায়ে অন্যায়-অসত্যের বিরুদ্ধে লড়েছেন - লড়ছেন। বেনিয়া ব্রিটিশের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন। পাকিস্তানের শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছেন-করছেন। লড়াই করেছেন। বিজয়ের মালা ছিনিয়ে এনেছেন।
সর্ব ভারতীয় মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা হয়েছিল আজকের স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানি ঢাকায়। পাকিস্তান সৃষ্টিতে বাঙালিদের অবদান ছিল। আবার বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় বাঙালিদের ভূমিকা ছিল বিশ্বের ইতিহাসে অনন্য। পাকিস্তানের শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে বাঙালিরা লড়েছেন। রক্ত দিয়েছেন। শহীদ হয়েছেন। পাকিস্তানিদের ঝেঁটিয়ে বিদায় দিয়েছেন। অত:পর সৃষ্টি করেছেন পৃথিবীর ইতিহাসে বাঙালিদের একমাত্র দেশ যার নাম বাংলাদেশ।
তারা সাম্রাজ্যবাদকে কখনও মেনে নেয়নি। আধিপত্যবাদকে গ্রহণ করেনি। সকল অপশক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন। প্রতিবাদ করেছেন। কোন অশুভ শক্তির কাছে মাথা নত করেননি। কোন অপশক্তির কাছে আত্মসমর্পন করেননি। তাদের পাঁচ হাজার বছরের ইতিহাস-ঐতিহ্যকে বিকিয়ে দেননি।
বহু আন্দোলন সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় আজকের বাংলাদেশ। দীর্ঘ এক ইতিহাস। এই ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় টিপু পাগলা, হাজী শরীয়তুল্লাহ, তিতুমির, ফকির মজনু শাহ, দেশবন্ধু সি.আর.দাস, একে ফজলুল হক, এইচ.এস সোহরাওয়ার্দী, কাজী নজরুল ইসলাম, মাওলানা ভাসানি, শেখ মুজিবর রহমান, মাওলানা মোহাম্মদ আকরাম খাঁ, মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী, আবুল হাসিম প্রমুখদের নাম ভেসে উঠে। এঁরা ইতিহাসের এক এক অধ্যায়ের নায়ক। এ সব মহান পথিকৃতরা আমাদের সকল আন্দোলন সংগ্রামের পুরোধা। তাঁদের অন্তরে ছিল আগুন। অন্যায় অত্যাচার ও অসত্যের সামনে কোনদিন মাথা নত করেননি। মাথা উঁচু করে থেকেছেন চিরজীবন। নিজেকে চেনার নতুন আশা দেখিয়েছেন। বিপ্লবের আদর্শে দিক্ষিত করেছেন। প্রতিবাদের ভাষা শিখিয়েছেন। শিখিয়েছেন জীবনবাজী রেখে ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে কিভাবে লড়াই করে বেঁচে থাকতে হয়?
শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান, নির্লোভ, নির্মোহ এবং ত্যাগী ছিলেন। অন্যায় অসত্যের কাছে তাঁরা মাথা নত করেননি। এক কথায় বাঙালিরা বীরের জাতি। সকল আন্দোলন-সংগ্রামের লড়াকু সৈনিক। আব্দুল হামিদ খান ভাসানি পাকিস্তানী স্বৈর শাসনের বিরুদ্ধে বাঙালির স্বায়ত্বশাসনের দাবি তুলে ধরেছিলেন এবং সম্পর্কচ্ছেদের আহবান জানিয়েছিলেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হুলিয়া-গ্রেফতারি পরোয়ানা মাথায় রেখে পাকিস্তানী স্বৈর শাসনের বিরুদ্ধে সারা বাংলা চষে বেড়িয়েছেন। স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় জীবনবাজি রেখে আগরতলা ষড়যন্ত্রে জড়িয়েছিলেন। এসব ছিল একজন জাতীয় বীরের জীবনে শ্রেষ্ঠ অর্জন। যা আজকের প্রেক্ষাপটে ভাবা যায় না।
সাধক কাজী নজরুল মাথার ওপর শত শত গ্রেফতারি পরোয়ানা মাথায় নিয়ে অবিভক্ত বাংলায় আন্দোলন-সংগ্রামে লেখনির মাধ্যমে মদত দিয়েছিলেন-যা বাঙালি জাতির জন্যে চিরদিন প্রেরণা হয়ে ছিল-আছে-থাকবে।
তিতুমীর স্বাধীনতার জন্য ইংরেজ দু:শাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন। তিনি জানতেন সাম্রারাজ্যবাদের আধুনিক সমরাস্ত্রের কাছে পরাজয় নিশ্চিত। তবুও জেনে-শুনে আত্মবিশ্বাসের বলে বলিয়ান হয়ে বাঁশের কেল্লা স্থাপন করেছিলেন। ইংরেজ দু:শাসনের জবাব দিয়েছিলেন। হাজী শরিয়তুল্লাহ জমিদার-মহাজনের অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছেন। দাড়ি রাখা কর প্রথার বিরুদ্ধে জীবনবাজি রেখে লড়েছেন। এসবই এক  এক আদর্শ ও দেশাত্ববোধের প্রেরণা।
তাদের উত্তরসূরি আমরা। কেন সেই বাঙালিরা আজ এত দূর্বল? কেন তারা আজ নানা ক্ষেত্রে ছন্নছাড়া? ভীতি বিহবল, নানা শংকা কেন তাদের আজ আচ্ছন্ন করে রেখেছে? কেন তারা প্রতিবাদের ভাষা হারিয়ে ফেলেছে? কেন তারা আজ নীরব, নিথর, নিশ্চল, জিম্মি? বিভক্ত আদর্শবোধ, জাতীয়তাবোধ ও ধর্মবোধ কি এর জন্য দায়ী ?

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন