সময়ের সাফ কথা
....
ধর্মের এক আধার হলো
বিজ্ঞান
দিগন্ত ॥ যে সকল বিধান ধারণ ও লালন-পালনে ব্যক্তি ও সমাজ
জীবনে শৃঙ্খলা, সুস্থতা তথা শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয় তাই ধর্ম। বিজ্ঞান শব্দটির অর্থ বিশেষ
জ্ঞান। জ্ঞান ভিন্ন সৃষ্টিকর্তাকে জানা যায় না, সৃষ্টিকর্তার উপাসনা করা যায় না। মূর্খের
কোন উপাসনা নেই। মূর্খের ধর্ম নাই বললেও অত্যুক্তি হয় না। মূর্খরাই সৃষ্টির কর্তাকে
মানে না। স্মর্তব্য, লেখাপড়া জানা কিংবা না জানা মূর্খতা বা জ্ঞানের মানদণ্ড নয়। লেখাপড়া
জানলেই কেউ জ্ঞানী হয় না কিংবা লেখাপড়া না জানলেও কেউ মূর্খ হয় না। জ্ঞান অন্য প্রকারে
অর্জিত হয়।
জ্ঞানীর জ্ঞানীকে বলে বিজ্ঞানী। বিজ্ঞানী ব্যস্ত থাকেন ধারাবাহিক
পর্যবেক্ষণ ও গবেষণা কিংবা সৃষ্টিকর্তার উপাসনায়। বিজ্ঞানীরা বিশেষ বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে
পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষণ করে বিধাতা কি বিধি দিয়ে বস্তুটি সৃষ্টি করেছেন তা জানার চেষ্টা
করেন এবং এই সব বিধিকে নিজেদের প্রয়োজনে ব্যবহার করার পদ্ধতি আবিষ্কার করেন।
জগত প্রাকৃতিক বিধান দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। গাছ থেকে আপেল মাটিতে
পতিত হয় মধ্যাকর্ষণ বিধিতে। কোন মন্ত্র, যজ্ঞ বা প্রার্থনা মধ্যাকর্ষণ শক্তিকে অকার্যকর
করতে পারে না। জগৎ ও জীবন কার্য-কারণ বিধিতে আবদ্ধ। মহাবিশ্বের প্রতিটি অস্তিত্ব বিধির
অধীন। এই সব বিধিকে জানা এবং মানা সুস্থ দেহে বেঁচে থাকা, ভারসাম্যপূর্ণ জীবন যাপন
করা এবং জীবনে শান্তি লাভ করার প্রধান শর্ত। বিধানের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ জীবনই শান্তির
জীবন বা ধর্মজীবন। বিধানের বিপরীতে কল্প কাহিনীর উপর নির্ভর করলে বিশৃঙ্খলা, হতাশা,
দুঃখ ও অশান্তি অনিবার্য। বিজ্ঞান বিধানগুলোকে জানছে এবং ব্যাখা করছে যুক্তিসঙ্গতভাবে
এবং প্রমাণ করছে যুক্তির যৌক্তিকতা। তাই শান্তিপূর্ণ জীবন যাপনের জন্য বিজ্ঞানের চর্চা
ও চর্যা অপরিহার্য।
প্রাকৃতিক বিধান জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে নিরপেক্ষ এবং
সর্বত্রই এক ও অপরিবর্তনীয় কিন্তু মানুষের তৈরি বিধান স্থান-কাল ভেদে ভিন্ন এবং পরিবর্তনশীল।
সতীদাহ প্রথা এক কালে ছিল ধর্মানুষ্ঠান কিন্তু এখন বর্বরতা ও কঠোর শস্তিযোগ্য অপরাধ।
ধর্মানুষ্ঠানিকতার এই বিবর্তনে রয়েছে বিশেষ জ্ঞান বা বিজ্ঞানের প্রভাব। যে যে ধর্মেই
বিশ্বাস করুক না কেন বিজ্ঞানের সূত্রগুলোকে শর্ত সাপেক্ষে মেনে নিতে বাধ্য। বিজ্ঞানকে
অস্বীকার করে ধর্মকর্ম তো দূরের কথা মানবজাতির অস্তিত্ব রক্ষা করাই অসম্ভব।
বিজ্ঞানের সূত্রগুলোই ধর্ম পালনে সৃষ্টি করছে যুক্তিশীলতা।
যেমন, বিজ্ঞানের সূত্র অনুসারে প্রতিটি ক্রিয়ারই
আছে একটি সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া! ধর্ম প্রতিষ্ঠার এটিই প্রধান সূত্র। কাউকে আঘাত
করলে সে সমান ও বিপরীত আঘাত করবে বা করতে চেষ্টা করবে তা যে কোন দিকে হোক। যে মানুষ
ভালোবাসার প্রতিক্রিয়ায় ঘৃণা দেয় সে প্রাকৃতিক এবং বৈজ্ঞানিক বিধি লঙ্ঘন করে ফলে সে
ঘৃণাই প্রাপ্ত হয়। ধর্মের এই তো সার কথা। বিজ্ঞান শিক্ষার ভিত্তিতে, মানুষের উন্নত
মস্তিষ্কের বুদ্ধি, বিবেচনা খাটিয়ে, মানুষ বৈজ্ঞানিক সত্যে উপনীত হয়েছে - 'এই পৃথিবীর
সকল মানুষ এক ও অভিন্ন প্রজাতি'। এই বৈজ্ঞানিক সত্যটির চর্যা পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠার
ক্ষেত্র অবারিত করতে পারে। যে সকল শাস্ত্র মানুষকে সম্প্রদায়ে বিভক্ত করে এবং মানুষের
সাথে মানুষের বিভেদ ও শত্রুতাকে উস্কে দেয় তা পরিত্যাগের সময় এসেছে।
আজ থেকে আড়াই হাজার বছর আগে অ্যারিষ্টটল বলেছিলেন - 'মানুষ
যুক্তিশীল প্রাণী'। যে যুক্তি মানে না সে মানুষ নয়। নিরন্তর চর্যার মাধ্যমে মানুষের
বুদ্ধিকে আরো শানিত করা, যুক্তিকে ত্রুটিমুক্ত করা, বিচার বিবেচনা এবং মস্তিষ্কের বিশ্ল্লেষণ
ক্ষমতাকে তীক্ষ্ণ করা ব্যতীত ধর্মচর্যা নেই,
কোন কালে ছিলও না। একমাত্র যুক্তি ও বুদ্ধি চর্যার মাধ্যমে মানুষ নিজের জন্য এবং মানব
জাতির জন্য কল্যাণ কর্মের সিদ্ধান্ত ও সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে পারে। একজন বৈজ্ঞানিক
এবং যুক্তিশীল মানুষের পক্ষেই কেবল ধার্মিক হওয়া সম্ভব।
বিজ্ঞান এখনো সব বিধান জানতে পারেনি কিন্তু বিধানকে জানার
জন্য বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার কোন বিকল্প নেই। প্রত্যেক সাধক একজন বিজ্ঞানী। জগত
ও জীবনের রহস্য উন্মোচন করাই সাধক ও বিজ্ঞানীর কাজ। ওয়াইক্লিফ, জন হাস, টমাস মুয়েনৎসার,
উইনস্টানলি, কপারনিকাস, জিওর্দানো ব্রুনো, গ্যালিলিও এঁদের সবাই ছিলেন সত্যানুসন্ধানী সাধক। আলবার্ট আইনস্টাইন
এবং বিজ্ঞানী আব্দুস সালামও ব্যতিক্রম নন।
সাহিত্য, দর্শন, জ্ঞান-বিজ্ঞান বিকশিত হয়েছে ধর্মকে ভিত্তি
করে। মানুষের মধ্যে অজানাকে জানার, সীমার মধ্যে থেকেও অসীমকে উপলব্ধি করার যে স্পৃহা
তা-ই মানুষকে যুগে যুগে করেছে বিকশিত। প্রায় ৩ হাজার বছর আগে প্রাচীন গ্রীসে মানুষের
চিন্তাশক্তির যে স্ফুরণ ঘটেছিলো তাও ছিলো ধর্মভিত্তিক।
বস্তুর ধর্মকে জানা বিজ্ঞানীর কাজ আর নিজ ধর্মকে জানা সাধকের
কাজ। বিজ্ঞানী বস্তুর ধর্মকে জেনে নিজেকে জানার দিকে অগ্রসর হন আর সাধক নিজেকে জেনে
বস্তুর ধর্মকে আবিষ্কার করেন। কল্যাণ ও অকল্যাণের মধ্যে পার্থক্য ব্যতীত তথা ধর্ম ব্যতীত
বিজ্ঞান টিকে থাকতে পারবে না। অন্যদিকে ধর্মেরও প্রয়োজন রয়েছে এমন এক আধারের যা ধর্মপ্রতিষ্ঠার
ক্ষেত্রকে প্রসারিত করবে।
বিজ্ঞান ধর্ম নয় কিন্তু ধর্মের আধার অবশ্যই। জ্ঞানের সকল
শাখা ধর্মের অন্তর্ভুক্ত। বিজ্ঞানের কোন সূত্রই ধর্মকে অপ্রমাণ করার প্রয়াসে আবিষ্কৃত
হয়নি। ধর্ম ও বিজ্ঞানের মধ্যে যারা দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করেন তারা বিজ্ঞানীও নয় ধার্মিকও
নয়। বিজ্ঞানী ও ধার্মিক উভয়েই সাক্ষ্যপ্রমাণ
ও পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে যা জানা যায় শুধুমাত্র তাকেই সত্য হিসেবে গ্রহণ করেন।
প্রযুক্তি উন্নয়নের এক অপরিহার্য শর্ত। কিন্তু প্রযুক্তিকে
কি লক্ষ্যে ব্যবহার করা হবে তা মানুষই নির্ধারণ করে। তাই মনুষ্য ধর্মের প্রতিষ্ঠা না
হলে প্রযুক্তিকে উন্নয়নের কাজে না লাগিয়ে ধ্বংসের কাজে লাগানো হবে। তাই পৃথিবীতে মনুষ্য
ধর্ম প্রতিষ্ঠার দায় রয়েছে বিজ্ঞানীদের।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন