বুধবার, ১১ নভেম্বর, ২০১৫

জিহ্বা শাসন জরুরি



জিহ্বা শাসন জরুরি


  সংস্কৃতিতে একটি কথা আছে, অনেকটা এরকম - ‘অপর্ণা মাংস হরিণা বৈরি’। বাংলায় যার অর্থ দাঁড়ায়, আপন মাংসই হরিণের শত্রু । কথাটির ব্যাখ্যা হচ্ছে, হরিণের মাংস সুস্বাদু তাই সিংহ, বাঘ থেকে শুরু করে মানুষ পর্যন্ত মুখিয়ে থাকে হরিণের মাংস খেতে। বাঘ তো রীতিমত হরিণখেকো। পুরনো দিনের রাজা বাদশাহদের একটা বড় শখই ছিল হরিণ শিকার করা। শিয়াল কিন্তু কেউ শিকার করতো না, করেও না! বাঘ কিংবা সিংহ পর্যন্ত শিয়াল শিকার করে এমন কথা শোনা যায় না। সহজেই অনুমান করা যায়, হরিণের মাংসের উল্টো স্বাদ মনে হয় শেয়ালের মাংসের। সুতরাং অংকটা সহজেই মিলে যায়। হরিণের মাংসই তার সবচেয়ে বড় শত্রু!
রাজনৈতিক নেতাদের বড় গুণ তাদের বাগ্মীতা। নেতা হওয়ার প্রাথমিক ও বড় গুণই হয়ে ওঠে বাকপটুতা। যার অগ্রসর ধারা হচ্ছে বাগ্মীতা। যা হয়ে উঠে বড় নেতা হওয়ার সহজ কিন্তু বেশ প্রয়োজনীয় শর্ত। জনপ্রিয় নেতা হয়ে উঠার ক্ষেত্রে তুখোড় বক্তা হিসেবে পরিচিতিটাই, ব্যতিক্রম ছাড়া, প্রায় সবার ক্ষেত্রেই প্রধান সিঁড়ি হয়ে থাকে। ‘মুজিবের ভাষণ’ বলে খ্যাত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের ৭ মার্চের জ্বালাময়ী বক্তৃতাই জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিয়েছিল পাকিস্তান নামক ফাঁকিস্তান রাষ্ট্রটিকে। ১৯৭১’ এর মুক্তিযুদ্ধ সেটিকে কবরেই পাঠিয়েছিল শুধু।
রাজনৈতিক নেতাদের এই বক্তৃতা তথা বাগ্মীতা তথা বাকপটুতা যেমন তাদের রাজনৈতিক জীবন চলার পথে উত্তরণ ঘটায়, ঠিক বিপরীতে তাদের মিথ্যা ভাষণ পতন-এর কারণও হয়ে থাকে। বেফাঁস কথা, অসতর্ক উচ্চারণ, লাগামহীন বক্তৃতা কেবল ব্যক্তি রাজনৈতিক নেতাকেই বিতর্কিত, দলচ্যুত এমনকি ক্ষমতাচ্যুত করে না, কোন কোন ক্ষেত্রে, এমনকি অনেক ক্ষেত্রে তার দল বা ক্ষমতাসীন অবস্থায় তার সরকারকেও অস্বস্তিতে ফেলে দেয়, সংকটগ্রস্ত করে তোলে, ঠেলে দেয় ক্রমশ শূন্যতার দিকে।
বিরোধীদলের ক্ষেত্রে বিষয়টি, অন্তত আমাদের মত দেশগুলোতে, তত একটা ধর্তব্যের মধ্যে পড়ে না। বিরোধী দলের নেতা, পাতি নেতারা লাগামহীন কথা বলে তিলকে তাল বলবেন, ঘোলকে জল বলবেন এ যেন ধরেই নেয়া হয়। ক্ষমতায় নেই তারা, ক্ষমতাহারা! তাদের মাথা তো খারাপ হতেই পারে! তাল-বেতাল ঠিক না হতেই পারে। কিন্তু সরকারি দলের ক্ষেত্রে বিষয়টি ঠিক উল্টো। মন্ত্রী-নেতা, সে কি বড় নেতাই হোক, কি মাঝারি বা পাতি নেতাই হোক, তাদের কাছ থেকে দায়িত্বশীল কথাবার্তা আশা করেন দেশের জনগণ। সরকার বা দল বেকায়দায় পড়ে, সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত বা বিতর্কিত হয় এমন কোন কথা মন্ত্রী-নেতারা বলা থেকে বিরত থাকবেন তা দলীয় কর্মী-সমর্থকদের রীতিমত দাবিও বটে।
সীমালঙ্ঘন সর্বক্ষেত্রে সকল সময়েই ক্ষতি ডেকে আনে! এর নজির ইতিহাসে ভুরি ভুরি। মন্ত্রীদের নেতাদের অসংযত জিহ্বা নিকট অতীতের সরকারগুলোর মত বর্তমান সরকারের জন্যও যে মাঝে মাঝে বিব্রতকর, অস্বস্তিকর এবং এমনকি জনপ্রিয়তা হানিকর হয়ে উঠছে তার জ্বলন্ত সাক্ষী সংবাদপত্রের পাতা আর জীবন্ত সাক্ষী টেলিভিশনের পর্দা। দেশ শাসনের চেয়ে জিহ্বা শাসন যে কম গুরুত্বপূর্ণ না এই সতর্কতাটা অন্তত প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে দলীয় মন্ত্রীদের-নেতাদের দিয়ে দেয়াটা কেবল দরকারি না, জরুরিও বটে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন